যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে ও অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের বাঁচাতে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিদেশিদের মধ্যে পাকিস্তান ও তুরস্কের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রধানসহ সে দেশের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিবিদরাও আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের এই বিচারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আইএসআইয়ের সাবেক প্রধানসহ এসব নেতা অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের রক্ষা করাটাকে তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করছেন। তাঁদের মতে, একাত্তরে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এবং এ দেশে গণহত্যা চালিয়ে তাঁরা দেশপ্রেমিকের কাজ করেছিলেন। কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিচারের বিপক্ষে বিদেশে লবিস্ট পর্যন্ত নিয়োগ করা হচ্ছে। অথচ এসব অপপ্রচার মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। বৃহস্পতিবারের কালের কণ্ঠে এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছে চার দশক ধরেই। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও রাজনীতিতে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের কারণে সেই বিচারের প্রক্রিয়া এত দিন নানাভাবে ব্যাহত হয়েছে। বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে বিচারের সপক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয় এবং দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ক্ষমতায় পাঠায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিলেও তাতে অনেক রকম ঘাটতি লক্ষ করা যায়, যার অন্যতম ছিল দীর্ঘসূত্রতা ও যথেষ্ট দক্ষ লোকবল নিয়োগ না করা। বর্তমানে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের দেশি-বিদেশি সমর্থকরা বিচারপ্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার জন্য নানা ধরনের অপপ্রচারের আশ্রয় নিচ্ছে। বিদেশে তদবিরকারী আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, কেবল জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী ২০১০-১১ সালে ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ ৮০ হাজার ডলার দিয়েছেন তাঁদের পক্ষে ওকালতি করার জন্য। বিদেশে অবস্থানরত পলাতক যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত সমর্থকরাও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা বিশেষ তহবিল গঠন করে বিচারপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। মুসলিম দেশগুলোকে তাঁরা বিচারের বিরুদ্ধে তৎপর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠি প্রদান এবং একটি বেসরকারি প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর তারই সাক্ষ্য বহন করে। এ রকম অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত ছিল এসব অপপ্রচার মোকাবিলায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা তুলে ধরা। কিন্তু সরকার এ ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বরং গণমাধ্যম ও সুধীসমাজ নিজস্ব দায়িত্ববোধ থেকে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
জামায়াত ও তাদের সমর্থক দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠী মুসলিম দেশগুলোকে প্রায় একতরফাভাবে বুঝিয়ে যাচ্ছে যে বাংলাদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারই অংশ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মতামতকে বুড়ো আঙুল দেখানোর কোনো সুযোগ আমাদের নেই। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারকাজ যে জনমতের প্রতিফলন, ধর্ম বা মানবতার স্বার্থেই যে এ বিচার হওয়া প্রয়োজন এবং এর মধ্যে যে স্বচ্ছতার কোনো ঘাটতি নেই, তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। আর তা করা না গেলে বিশ্ববাসীর কাছে এই বিচারের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন জাগবে। কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আয়োজন করার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বিচারের স্বচ্ছতা তুলে ধরতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান উদ্যোগটি সরকারকেই নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.