প্রশাসনের প্রতিটি সত্মরে দলীয়করণের যন্ত্রণা ভোগ করছি- সংসদে প্রশ্নোত্তরে- প্রধানমন্ত্রী

 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে এখনও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সীমাহীন দলীয়করণের যন্ত্রণা ভোগ করছেন। এ কথা স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রশাসনের প্রতিটি সত্মরে এমন দলীয়করণ করা হয়েছে যে, সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা তা উপলব্ধি করছি।
সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে নানা ক্ষেত্রে বাধা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সরকারী কাজে নানা সমস্যা ও অযথা বিলম্ব করা হচ্ছে।
সংসদ ভবন সংলগ্ন চন্দ্রিমা উদ্যানে সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল (অব) শহীদ জিয়াউর রহমানের লাশ আদৌ আছে কি-না, তা নিয়ে আবারও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি মনত্মব্য করেন, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করা উচিত ছিল। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সরকারী নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ করা না হলে দায়ীদের চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি এও ঘোষণা দেন, যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য পুলিশ বাহিনীর মতো রেশন প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে সেক্টর কমান্ডার ও তিন ফোর্স কমান্ডারদেরও কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে কি-না, সরকারী দলের সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদৌ চন্দ্রিমা উদ্যানের কবরে জিয়ার লাশ আছে কি-না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দীহান। অথচ এই কবরকে ঘিরে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তিনি বলেন, মৃতু্যর পর জিয়ার লাশ কেউ-ই দেখতে পারেনি। তিনি গুলিতে মারা গেছেন। তার লাশ থাকার কথা। কিন্তু একটি বাঙ্ এনে চন্দ্রিমা উদ্যানে কবর দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই বাঙ্ েজিয়াউর রহমানের লাশ আছে কি-না, তা তাঁর স্ত্রী-সনত্মানদেরও দেখানো হয়নি। এমনকি যেখান থেকে লাশের বাঙ্টি তোলা হয়েছিল সেখানে যে আদৌ জিয়ার লাশ ছিল; তা কেউ শনাক্ত করেছেন, এমন প্রমাণও নেই। এ নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ রয়েই গেছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের জয়নাল আবেদীনের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, জেনারেল জিয়া তাঁর জীবনরক্ষাকারী সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের, ব্রিগেডিয়ার হুদা, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফসহ বেশ কয়েক সেক্টর কমান্ডার এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তাই, এমন এক ব্যক্তির কবরের পাশে সেক্টর কমান্ডার ও তিন ফোর্স কমান্ডারের লাশ দাফন করতে তাঁদের পরিবারই রাজি হবেন কি-না, এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
জেনারেল জিয়া ও তাঁর পরিবারের বিরম্নদ্ধে যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা খেলা চিরতরে বন্ধ করা উচিত। এর ্আগে ক্ষমতায় থাকার সময় নিজ হাতে ৭০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করেছিলাম। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এসেই সেই সার্টিফিকেট বাতিল করে দিয়ে নিজেরা মুক্তিযোদ্ধাদের মনগড়া ভুয়া তালিকা করে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে দুই নম্বরী করেছে। তিনি সকল সংসদ সদস্যের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করবে, এটা স্বাভাবিক। তাই নিজ নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করম্নন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তালিকা থেকে বাদ দিতে সহযোগিতা করম্নন।
সরকারী দলের এ্যাডভোকেট সানজিদা খানমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, স্বাস্থ্য সহকারীসহ অনেক জায়গায় নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা মানা হচ্ছে না। চারদলীয় জোট সরকার পাঁচ বছরে সর্বক্ষেত্রে এমন দলীয়করণ করে গেছে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এখনও সরকার পরিচালনায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে, সরকারী নানা কাজে অযথা বিলম্ব করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণের ব্যাপারে সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, কোটা পূরণ হচ্ছে না, এমন কোন তথ্য থাকলে জানানো হলে জড়িতদের বিরম্নদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরকারী দলের সাংসদ গোলাম দসত্মগীর গাজী বীরপ্রতীকের মূল প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা ৫ হাজার ৮৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৭ হাজার ২০ টাকা করা হয়েছে। তা ছাড়া ৫ হাজার ৩৩০ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ৪০ শতাংশ পর্যনত্ম বৃদ্ধি করা হয়েছে। অন্যদিকে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা ৯শ' টাকা থেকে বৃদ্ধি করে দেড় হাজার টাকা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা এটি বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করার সিদ্ধানত্ম নিয়েছি।
যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য পুলিশ বাহিনীর মতো রেশন প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাছাড়া অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাভোগীর সংখ্যা এক লাখ থেকে বৃদ্ধি করে এক লাখ ২৫ হাজার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে ভাতাভোগীর সংখ্যা এবং ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। তা ছাড়া খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপির মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি ষাটোর্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের বাস, ট্রেন ও লঞ্চে বিনামূল্যে চলাচলের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পোষ্যদের আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য বিআরডিবি ও যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্রঋণ প্রদান কার্যক্রম চলমান আছে।
সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের জন্য দেশের লাভবান প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে দিয়েছিলেন; যাতে এর লভাংশ থেকে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা সাহায্য পেতে পারেন। কিন্তু '৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান এবং তার পরবতর্ী সরকারগুলো ক্ষমতায় থেকে কল্যাণ ট্রাস্টকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে এমন অলাভজনক করে যে, এখন তা রীতিমতো বোঝায় পরিণত হয়েছে। তাই কল্যাণ ট্রাস্টের জায়গা বিক্রি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভবান করে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে স্থায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা, সরকার তা সক্রিয় বিবেচনা করছে।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নুর প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী জানান, 'ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং সংরক্ষণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)' শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে একটি উন্নয়ন প্রকল্প দেশব্যাপী বাসত্মবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রসত্মাব চূড়ানত্ম করা হয়েছে। মোঃ শাহাবুদ্দীনের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাঁর সরকার ইউনিয়ন পর্যনত্ম ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় আনবে। উপজেলা পর্যায়ে বসেও যে কেউ যাতে নিজের জমি সংক্রানত্ম সকল বিষয় জানতে পারেন সে জন্য পুরো ভূমি জরিপ ও রেকর্ড প্রণয়নের কাজকে ডিজিটালের আওতায় আনা হবে।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, জমিজমা নিয়ে বিরোধ নতুন নয়। এক বিঘা জমি নিয়ে মামলা চালাতে ১০ বিঘা জমি বিক্রি করে সর্বশানত্ম হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনা হলে উপজেলায় বসেও যে কোন মানুষ জমির ব্যাপারে সিদ্ধানত্ম নিতে পারবে। এতে অযথা মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যাও কমে যাবে, জমি নিয়ে খুনখারাবি, হানাহানি-মারামারি ও মামলাবাজির হাত থেকে জনগণ রেহাই পাবে।
সরকারী দলের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, পর্যটন খাতকে উৎসাহ দেয়ার জন্য এ বছর একটি মাসকে 'পর্যটন মাস' হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে। তাছাড়া আগামী বছরের বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ওই বছরকে 'পর্যটন বর্ষ' হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধানত্ম হয়েছে। দেশের পর্যটন খাতের প্রসার ও ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে এ কাজ করা হবে। তাছাড়া বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য 'টু্যরিস্ট পুলিশ' গঠন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাংলাদেশে বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সরকার থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
সরকারী দলের সদস্য এ্যাডভোকেট রহমত আলীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, রাজধানী উন্নয়ন কর্পোরেশনের আওতাধীন ৫৯০ বর্গকিলোমিটারের ঢাকা শহরকে ১৫২৮ বর্গকিলোমিটারে উন্নীত করার সিদ্ধানত্ম হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট পস্নানের আওতায় এ কাজ করা হবে। তাতে উত্তরে গাজীপুর পৌরসভা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী, পশ্চিমে বংশী ও ধলেশ্বরী নদী এবং পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী, সোনারগাঁও থানার অংশবিশেষ ও মেঘনা নদী পর্যনত্ম বিসত্মৃত করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.