ছেলেবেলার সোনালি দিন স্মৃতিময় ইচিং বিচিং হাডুডু ডাংগুলি- শৈশব-কৈশোরের মজার খেলা

ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো এখন কত দূরে আর আসে না রাজার কুমার পঙ্খীরাজে উড়ে...’ হেমন্তের কণ্ঠে পুরনো দিনের এই গান শুনলে প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের স্মৃতির পাতা মেলে যায়। ফিরে যান শৈশব থেকে যৌবনে পৌঁছার মধ্যের সেই দিনগুলোতে।
যেখানে ছিল মিষ্টি দুরন্তপনার কতই না মজার খেলা। চির চেনা সবুজ ঘাসের প্রান্তর। শীতের সময়টায় হেঁটে দূরে কোথাও যেতে ধান কাটা জমির ওপর দিয়ে শর্টকাট রাস্তা। নদী তীরে নৌকা দেখলেই বৈঠা বইয়ে ওপারে যাওয়া। কখনও মাটির পথ ধরে উচ্ছ্বাসের ভোঁ দৌড়। কাদার জমিতে গিয়ে কাদা মেখে সং সেজে ডাঙ্গুলি ও হাডুডু খেলার মহা আনন্দ। পাঠশালায় গিয়ে অপেক্ষা। কখন ছুটি হবে, কখন বাজবে সেই ঘণ্টা। ছুটির ঘণ্টা বাজার সঙ্গেই কি হুড়োহুড়ি। মেঠো পথ ঝাউবন, নদী তীর গাছগাছালি বাঁশ বাগানের মধ্য দিয়ে মাঠ প্রান্তর ছাড়িয়ে আপন মনে পথ চলা। ফের ফিরে আসা। মাটির অপার মমত্বের সেই দিন। সেদিনের শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে অচেনা।
ওরা বেড়ে উঠছে ইটপাথরের কংক্রিটের বনে। যেখানে মনটিও কঠিন হয়ে ওঠে। বর্তমানের গ্রামও সেই চেনা গ্রাম নেই। এগিয়ে চলার পালায় গ্রামও শহুরে জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে। শৈশবের গ্রামীণ সেই খেলাও দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। কারও কি মনে আছে একটা সময়ে গ্রামে বাটুলের মতো করে চেঙ্গু পান্টি বানিয়ে কাঠের ছোট টুকরো নিয়ে ছুড়ে দেয়া হতো। সেই টুকরো দ্রুত ধরে ফিরিয়ে দিতে পারলে আউট। প্রায় একই ধরনের খেলা ডাঙ্গুলি। এমন খেলার পর শরীর নেতিয়ে বাড়ি ফেরা। সন্ধ্যার ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে মাটিতে মাদুর পেতে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসে ভাবনা পরের দিনে কি ভাবে প্রতিপক্ষকে হারানো যায়। ঝিঁঝিঁ পোকার ভাবনার এই খেলাটিই আজকের ক্রিকেট (ক্রিকেট অর্থ ঝিঁঝিঁ পোকা) ম্যাচ। গ্রামেও ওডিআই/ টি টুয়েন্টি টুয়েন্টি/টেস্ট ম্যাচের ক্রেজ চলে গিয়েছে। বর্তমানের তরুণ ডাঙ্গুলি চেঙ্গু পান্টি চেনে না। মেয়েরাই বা কতটা জানে সেদিনের সেই খেলা।! ওদের ক্রিকেট ক্রেজ আরও বেশি। ছেলে মেয়ে মিলে ‘ওপেনটি বাইস্কোপ টেন টেন তেইশকোপ চুলটানা বিবিয়ানা সাহেব বাবুর বৈঠকখানা, সাহেব বাবু বলেছে পান সুপারি খেতে পানের আটা মৌরি বাটা ¯িপ্রংয়ের চাবি আটা আমার নাম রেনু বালা আমি যাবো যশোর জেলা’ এমন ছন্দে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে এলোমেলো হয়ে যাওয়ার সেদিনের একটি খেলা। বগুড়ার সোনাতলা এলাকার রাহেলা বিবি (৭০) এই ছড়া মুখস্থ পাঠে স্মৃতিচারণ করলেন। চোখের কোনে বয়ে এলা দু’ফোটা জল। বললেন রেলগাড়িকে নিয়েও এমন ছড়ার খেলা আছে। ছেলে মেয়েরা একে অপরের কোমর ধরে লাইন হয়ে ছন্দ করে বলতো ‘আইকুম বাইকুম তাড়াতাড়ি যদু মাস্টার শ্বশুর বাড়ি রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম।’ কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেন নিয়ে শিশুদের খেলা ‘ঝুকঝুকঝুকঝুক ময়মনসিংহ আইতে যাইতে কতদিন।’ গ্রামের ছেলেরা পাথারের মধ্যে জাম্বুরাকে বল বানিয়ে অথবা খড় একত্রে গোল করে বেঁধে ফুটবল খেলত। ছোট মেয়েরা উঠানে বসে হাঁটুর ওপরে কয়েকটি আঙুল তুলে প্রতিপক্ষকে লাফিয়ে পার হতে বলত। এভাবে লাফানোর উচ্চতা বাড়িয়ে যে দল এগিয়ে যেতো সেই দলই বিজয়ী। উঠানে ছোট্ট গর্ত করে মার্বেল খেলার সে কি নেশা! ‘থ্রি সিক্স নাইন, যাত্যে আসতে নট পাটকে’ এগুলো মার্বেল খেলার সঙ্কেত। প্রথমে মার্বেল মাটিতে গড়িয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের নির্দেশে নির্দিষ্ট মার্বেলকে হাতের মার্বেল দিয়ে টাচ করলেই জেতা। যে জিতত তার তত মার্বেল। এই খেলার জন্য কতজন যে অভিভাবকের মার খেয়েছে...। ইটের টুকরোর ৫টি ঘুঁটি বানিয়ে ওপরে তুলে ছেড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ার পর আরেকটি ঘুঁট দিয়ে একটা দুইটা তিনটা চারটা ঘুঁটি হাতে ভরে হারজিতের খেলা। কখনও এই খেলায় সঙ্গী হতো। উঠানে কাঠি দিয়ে চৌকোণা দশটি ঘর এঁকে এক পা তুলে আরেক পা দিয়ে কুতকুতকুতকুত শব্দে দাগের ওপর পা না ঠেকিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মজার এই খেলা। প্রায় একই ধরনের দাড়িয়া বান্ধা খেলায় একটা ছোট চাতকি ঘরে ফেলে সেখানে এগিয়ে যাওয়া। এ যুগের তরুণী সেলিনা শিউলি বললেন শৈশবের কোন খেলা দেখলেই তিনি ক্যামেরাবন্দী করে রাখেন। মাটিতে ছোট্ট চৌকোণা ঘর বানিয়ে দুই প্রান্তের নির্দিষ্ট ৪টি ঘরে ৮টি করে ছোট কাঠি বসিয়ে চাল দেয়া হতো। যার চালে বুদ্ধিমত্তা সে অপর পক্ষের কাঠি দ্রুত খেয়ে ফেলত। এই খেলার নাম বাঘ ছাগল। বৌ-বানিয়ে বৌছি খেলার কথা আজও অনেক মেয়ের স্মৃতিতে আছে। একই ধরনের চোখ বেঁধে দিয়ে কাউকে খুঁজে বের করার কানামাছি ভোঁভোঁ যাকে পাবি তারে ছোঁ খেলার কথা মনে হলে অনেকের কিশোর প্রণয়ের কথা জেগে ওঠে। কেউ কোথাও লুকিয়ে টুকি শব্দ করে জানান দিয়ে খুঁজে বের করার লুকোচুরি খেলাটিও ছিল মধুময়তার ঘেরা। শৈশবে দড়ি খেলা খেলেনি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া বিরল। ছেলে মেয়েরা মিলে জোড়বেজড় ও টুকরো কাগজে চোর পুলিশ খেলার কথা সহজে কেউ ভোলে! রুমাল চুরি ও বাালিশ খেলা কিই না মজার! শিশু মনের ব্যাপ্তি যে কতটা তার প্রকাশ পায় শৈশবের খেলায়। অরূপের অন্ধকার থেকে প্রথম আলো বিন্দু এসে ঝরে পড়ে রূপের জগতে। শিশুর প্রথম আবির্ভাবেই চেতনার জন্ম হয়। আত্মচেতনা উপলব্ধির মন্ত্রে মায়ের কোলে মায়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠে। মনুষ্যত্বের আশ্বাসে শিশু একদিন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এসে পৌঁছায় কৈশোরের উচ্ছলতায় তারুণ্যের উদ্দীপনায়। তার কাছে তখন সব অসম্ভবই সম্ভব, সব অগম্যই গম্য। যে কোন বাজিতে প্রস্তুত। এক ডুবে ভরা নদী পার হতেও বাঁধা নেই। যৌবনে পদার্পণের আগের এই দিনগুলোতেই ইচ্ছেমতো কতই না মধুময় খেলা। ক’জনাই মনে রাখে...।

No comments

Powered by Blogger.