জন্মশত বার্ষিকী-দুঃসময়ের কাণ্ডারি by ড. রঙ্গলাল সেন

বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় হয় স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭২-৭৩ সালে, তিনি তখন বাংলা একাডেমীর অনুবাদ বিভাগের প্রধান ছিলেন।
১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাজমুল করিমের স্মারক বক্তৃতা উপলক্ষে তার সঙ্গে আমার নতুন করে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এতে তাকে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। স্মারক বক্তৃতার কপি অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে তার কাছ থেকে নিয়ে আসতে তার বাসায় যাই। বক্তৃতাটি সুলিখিত ও সুচিন্তিত কিন্তু 'জয়বাংলা' দিয়ে বক্তৃতাটির ইতি টেনেছেন। তৎকালীন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান ছাত্র রাজনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী ছাত্রশক্তির প্রাধান্য থাকার কারণে আমি অনেকটা সাহস করে তাকে অনুরোধ করলাম 'জয়বাংলা' শব্দটি কি না থাকলে চলে না? আপনি সেটা মুখে বললে সমস্যা হবে না। তখন তিনি আমাকে অনেকটা ক্রোধান্বিত হয়ে বলে উঠলেন, 'তাহলে আমি বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি না, আমার লেখাটি ফেরত দেন।' ওইদিনই আমি এবং আমার সঙ্গে যাওয়া সহকর্মী তার প্রকৃত পরিচয় পাই। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সাহস করে বলে ফেললাম। আপনার বক্তৃতার শেষে লিখিত 'জয়বাংলা' থাকবে। বক্তৃতা আমি ফেরত দিচ্ছি না। বক্তৃতার কপি করা হলো। টিএসসির মঞ্চে তৎকালীন উপাচার্য আবদুল মান্নান প্রধান অতিথি ছিলেন। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমি সভাপতিত্ব করি। এ ছাড়া আরও দু'জন প্রবীণ শিক্ষক, প্রয়াত অধ্যাপক আফসার উদ্দিন ও অধ্যাপক সাদ উদ্দীন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। টিএসসির মিলনায়তন দর্শকশ্রোতায় ছিল পরিপূর্ণ। আবু জাফর শামসুদ্দীন যখন তার বক্তৃতার পাঠ শুরু করেন তখন তার বক্তৃতার কপি সুধীমণ্ডলীর কাছে বিতরণ করা হয়। বক্তৃতা শেষ না হতেই দর্শক-শ্রোতা থেকে বিভাগের এক ছাত্রনেতা মঞ্চে উঠে আমাকে লক্ষ্য করে বলে_ বক্তৃতার সঙ্গে 'জয়বাংলা' থাকায় নাকি ছাত্রদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। আমি তখন ওই ছাত্রনেতাকে ধমক দিয়ে বলি, 'শান্ত হয়ে বসে বক্তৃতা শোন।' এরপর অবশ্য যথারীতি বক্তৃতা শেষ হলো। সৌভাগ্যবশত বক্তৃতা সুন্দরভাবে পরিবেশিত হয়। কোনো ছাত্র গণ্ডগোল করেনি।
আবু জাফর শামসুদ্দীনের সঙ্গে আরেকটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে যুক্ত থাকার সুবাদে পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হয়। সংগঠনটি ছিল 'আফ্রো এশিয়ান পিপলস সলিডারিটি অর্গানাইজেশন', সংক্ষেপে_ আপসো। তিনি ছিলেন ওই সংগঠনের সভাপতি। সংগঠনটি ছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সেতুবন্ধস্বরূপ।
আবু জাফর শামসুদ্দীন ছিলেন একজন বন্ধুবৎসল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিনিময় ও তর্ক-বিতর্ক করতে ভালোবাসতেন। তখন নানা প্রসঙ্গ এনে আলোচনা হতো। ১৯৫৭ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে যখন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ টাঙ্গাইলে কাগমারী সম্মেলনে বিভক্ত হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) জন্ম হয়, তখন তিনি মওলানা ভাসানীর পার্টি ন্যাপের সঙ্গেই থাকেন। মূল আওয়ামী লীগ তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সংগঠন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি হলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। এ সংগঠনটি এখনও টিকে আছে বর্তমানে ১৪ দলীয় জোটের একটি দল হিসেবে।
আবু জাফর শামসুদ্দীনের শেষ জীবনে এই ন্যাপের সঙ্গে আর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর থেকে। এ সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বলিষ্ঠ লেখনী পরিচালনা করতে থাকেন। দৈনিক সংবাদে তার লেখাগুলো থাকত যুক্তি ও তথ্যে পূর্ণ এবং ওই দুঃসময়ে তা প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রকামী প্রতিটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করত।
কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হওয়ার কারণ ছিল দুটি। একটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও পাকিস্তানের মার্কিন নেতৃত্বাধীন সিয়েটো সেন্টোতে অন্তর্ভুক্তি। আওয়ামী লীগের যারা ন্যাপ গঠন করেন তারা পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি সমর্থন করেন, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির ঘোর বিরোধী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মার্কিন প্রভাবাধীন মার্কিন সিয়েটো সেন্টো ত্যাগ করতে অনিচ্ছুক; কিন্তু আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অনেকটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। তিনি মনে মনে ন্যাপের দাবির সঙ্গে সমর্থন জানান; কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে চান না। এ নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানও কম সমালোচিত হননি। তা সত্ত্বেও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলে কিছু দিন পর সংগঠনের সভাপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান আর তাজউদ্দীন আহমদ হন এর সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রণীত ৬ দফা এবং ১৯৬৯ সালের ছাত্রদের প্রণীত ১১ দফার আন্দোলনের মাধ্যমে যে গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয় তারই পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। আশির দশকের গোড়ার দিকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তার আগে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আরেক সমরনায়ক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একদিকে সামরিকীকরণ অন্যদিকে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রভাব বিস্তার করে। সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন তার উল্লেখযোগ্য রচনায় এসবের বিরোধিতা করে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে একদিন আমি এবং সম্প্রতি প্রয়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান ও তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা রাজনীতির একটি বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণের জন্য তার বাসায় যাই। তিনি তখন খোলামেলা আলোচনায় বলেই ফেললেন, শেখ মুজিবের যতই সমালোচনা করা হোক না কেন_ আমিও তার অনেক সমালোচনা করেছি, তবুও এ কথা মানতেই হবে, তার যত দুর্বলতা থাকুক না কেন তিনি তার জীবন দিয়ে আমাদের স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। তার কাছে সমগ্র বাঙালি জাতি ঋণী এবং চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
পরিশেষে আমি বলতে চাই, বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন শ্রেণী সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্রী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ও উদ্বুদ্ধ থাকলেও তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদে ছিলেন প্রবল বিশ্বাসী। উপরোলি্লখিত স্মারক বক্তৃতা শেষে 'জয়বাংলা' লেখাই তার যথার্থ প্রমাণ। আমি প্রয়াত আবু জাফর শামসুদ্দীনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

ড. রঙ্গলাল সেন : প্রফেসর, ইমেরিটাস সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.