সময়চিত্র- মুক্তিযুদ্ধ: চেতনার রাজনীতি by আসিফ নজরুল

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমরা প্রায়ই কথা বলি। সবচেয়ে বেশি বলেন রাজনীতিবিদেরা। তাঁদের বক্তব্যে এই চেতনা নিয়ে তেমন সারগর্ভ কথা নেই। কারণে-অকারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ-বিপক্ষের ছাপ মেরে দিতেই তাঁদের (এবং রাজনৈতিক সুবিধাভোগী মানুষ) বেশি আগ্রহী দেখা যায়।
অবস্থা মাঝেমধ্যে এমন দাঁড়ায় যে দেশের সিংহভাগ জনতাকেই তাঁরা কোনো না কোনোভাবে চেতনাবিরোধী হিসেবে অভিহিত করেন। আওয়ামী লীগ, তাদের সরকারের কার্যক্রম, বঙ্গবন্ধু, ১৯৭২-এর সংবিধান, এমনকি ভারতবিরোধী কোনো সমালোচনা হলে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী—এ ধরনের সাধারণীকরণ বিরল নয় এ দেশে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অহংকার, সবচেয়ে বড় অর্জন। কিন্তু এই চেতনা নিয়ে রাজনীতি যতটা হয়েছে, একে সঠিকভাবে আত্মস্থ করে জাতি গঠনের কাজটি হয়নি সেভাবে। এই চেতনাকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের দায়িত্ব পর্যন্ত আমরা অধিকাংশ সময় পালন করি না। অথচ ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্কে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী, তা স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। এসব দলিল অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় দুটো চেতনার একটি হচ্ছে গণতন্ত্র, অন্যটি অর্থনৈতিক সাম্য ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। অসাম্প্রদায়িকতা, আইনের শাসন কিংবা মানবাধিকার গণতন্ত্রের অনুষঙ্গ। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র অর্থনৈতিক সাম্যেরই রাজনৈতিক প্রকাশভঙ্গি।
রাজনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের যতটা সক্রিয়তা দেখা যায়, সাম্যভিত্তিক বা শোষণমুক্ত সমাজ সৃষ্টি নিয়ে তার প্রায় কিছুই লক্ষ করা যায় না। এই গণতন্ত্র নিয়েও কথামালার রাজনীতি হয়েছে, একে বিনির্মাণে খুব একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কোনো সরকারকে। অন্যদিকে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার মুক্তিযুদ্ধের যে অন্যতম চেতনা, তার বিরোধী কাজে কম-বেশি লিপ্ত ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি সরকার।

২.
গণতন্ত্র কেন ও কীভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় চেতনা, তার কোনো বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট যদি হয় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল, তাহলে এ সময়ে বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় সংগ্রামই ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৫৪ সাল এবং ১৯৭০ সালে দুটো নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও আমাদের গণতন্ত্রকে বিজয়ী হতে দেয়নি পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা। বরং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য চালানো হয় মানব ইতিহাসের অন্যতম নারকীয় গণহত্যা। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ চালাবেন, জনগণের অধিকার, স্বার্থ ও কল্যাণ তাতে নিশ্চিত হবে—এই চেতনা মানুষের মনে এতটাই তীব্র ছিল যে তারপরও ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ।
গণতন্ত্র বলতে বাংলাদেশের মানুষ কোনো পোশাকি বা আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব গণতন্ত্রকে বোঝায়নি। বুঝিয়েছিল উদার ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা থেকে শুরু করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো এবং বিশেষ করে ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্কে তাই গণতন্ত্র বলতে অবাধ নির্বাচন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, জনমতসচেতন সরকার, বিরোধী দলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালনার কথা বিভিন্নভাবে উল্লিখিত হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তা বহুলাংশে প্রতিফলিত হয়েছে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য কিছু অত্যাবশ্যকীয় কাজ আগামী সংসদের আইনের মাধ্যমে সম্পাদনের তাগিদও রয়েছে এতে। যেমন: অধস্তন আদালতকে মৌলিক মানবাধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার প্রদান (অনুচ্ছেদ ৪৪), নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতায়ন (অনুচ্ছেদ ৫৯, ৬০), সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ (৭৬), নির্বাচন কমিশনারদের কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ (১১৮)। বলা বাহুল্য যে উপরিউক্ত কার্যাবলির অধিকাংশই বাংলাদেশের নির্বাচিত সংসদগুলো গত ৪০ বছরে সম্পাদন করেনি। বরং সামরিক শাসকদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অর্থাৎ গণতন্ত্রকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। সামরিক শাসকের গণতন্ত্রবিনাশী কার্যকলাপ (যেমন জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী ও এরশাদের সপ্তম সংশোধনী) আদালতের রায়, রাজনীতিবিদদের বক্তব্য, বিবৃতি এবং সমাজের বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ায় যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে রাজনৈতিক সরকারের আমলের গণতন্ত্রবিরোধী কার্যক্রম সেভাবে আলোচিত হয়নি। অথচ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর প্রথম চরম আঘাত এসেছে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রণীত চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমেই। এই সংশোধনীতে একটি বাদে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়, সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি পত্রিকা বাদে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়, জনগণের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, সর্বোপরি একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
নব্বই-পরবর্তী ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ সময়ে গণতন্ত্রকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব করে ফেলা হয়। পার্লামেন্টকে অকার্যকর পরিণত করে, সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরকারেরই আজ্ঞাবহ করে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে, স্থানীয় শাসনকে খর্ব বা নামসর্বস্ব করে ফেলে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিতকে নড়বড়ে করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে আমরা বুঝতে পারি, পঞ্চাশের দশক থেকেই গণতন্ত্র বলতে এ দেশের মানুষ তৃণমূলের প্রতিনিধিকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া, অসামপ্রদায়িক রাজনীতি প্রতিরোধ করা, দলের ভেতর গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্বের চর্চা, নির্বাচনে টাকা ও মাস্তানি প্রতিরোধ করা এবং মানুষের কাছে নেতার জবাবদিহিকেও বোঝাত। প্রায় গত ২০ বছরের শাসনামলে গণতন্ত্রের এসব চেতনাকে প্রতিফলিত করতে কমবেশি ব্যর্থ হয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুটো দলই। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে বিএনপির গত সরকারের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি ন্যক্কারজনক।

৩.
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলনে আরও বড় ব্যর্থতা আমরা দেখি সাম্যভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। ১৯৫০ সালে গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনের প্রস্তাব থেকে ১৯৬৬ সালের ছয় দফার অন্যতম লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক বঞ্চনার অবসান। ১৯৬৯ সালের ছাত্রসমাজের ১১ দফা, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো এবং বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী জনসভায় আরও স্পষ্টভাবে বঞ্চিত মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের কথা বলা হয়। ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্কে এসবের ওপর এতটাই জোর দেওয়া হয় যে এই পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধানের ছত্রে ছত্রে আমরা এর প্রতিফলন দেখি। সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা; ১৩ অনুচ্ছেদে উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন-প্রণালির ওপর জনগণের মালিকানা; ১৪ অনুচ্ছেদে সকল প্রকার অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মেহনতি মানুষের মুক্তি; ১৫ অনুচ্ছেদে সব মানুষের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার; ১৬ অনুচ্ছেদে শহর ও গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর; ১৯ অনুচ্ছেদে মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা; ২০ অনুচ্ছেদে অনুপার্জিত অর্থ (দুর্নীতির অর্থ/কালোটাকা) ভোগের সুযোগ বিলোপের কথা বলা হয়। শোষক রাষ্ট্রের বদলে সেবামুখী রাষ্ট্র তৈরির জন্য ২১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’
স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে শিল্পকারখানা জাতীয়করণ এবং কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। তিনি নিজ দলের লোকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেছেন, চতুর্থ সংশোধনী পাসের দিন সংসদে দেওয়া ভাষণে বারবার দুর্নীতির জন্য সমাজের শিক্ষিত ও ওপরতলার মানুষকে দায়ী করেছেন, এদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। দেশ শাসনের জন্য যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তিনি খুব কম সময় পেয়েছিলেন। মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্নের কথা তিনি সারা জীবন আবেগরুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, তা তিনি সত্যি কতটুকু পারতেন বা করতেন, তা বিশ্লেষণের জন্য এটি যথেষ্ট সময় ছিল না। দেশ শাসনের জন্য কম সময় পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানও। তবে বঙ্গবন্ধুর সময়ে কালোবাজারি, চোরাচালানি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল ও পারমিটবাজির মাধ্যমে দেশে প্রথম কিছু লোকের হাতে অঢেল বিত্ত পুঞ্জীভূত হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে প্রথম বিরাষ্ট্রীকরণ, ব্যাংক-বিমার লাইসেন্স, অবৈধ বিত্তের ভোগ ও বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সূচনা ঘটে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনুপার্জিত অর্থ ভোগের ব্যবস্থাও বাংলাদেশে তিনি প্রথম শুরু করেন।
স্বাধীনতাসংগ্রামের দীর্ঘ সময়ে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ও সমাজের একটি শ্রেণীর হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের বিরুদ্ধে যে দৃঢ় চেতনা গড়ে ওঠে, তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেন এরশাদ। তিনি নিজে শুধু দুর্নীতিবাজ ছিলেন না, অশুভ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য তিনি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণও করেন। তাঁর শাসনামলে প্রথম উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উচ্চবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে, এদের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমে ওঠে। গণতান্ত্রিক শাসনামলে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুর্নীতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে এবং রাষ্ট্রের সম্পদ ও পুঁজিকে নিজ দল, তাদের অনুগত ব্যক্তি বা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে অসুস্থ পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে আরও জোরালো করে তোলে। লুটপাট, দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক হাজার ব্যক্তি শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যায়, কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়। গত ৩০ বছরে রাষ্ট্রব্যবস্থা চরমভাবে বৈষম্য ও দুর্নীতিবান্ধব হয়ে ওঠে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার যে চেতনা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নিয়ামক ছিল, তা বহুলাংশে ভূলুণ্ঠিত হয়।

৪.
আশার কথা এই যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেকাংশে ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হূদয়ঙ্গম করতে ভুল করেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে স্বেচ্ছাচারিতা ও কথামালার রাজনীতি তাই তারা গ্রহণ করেনি। স্বাধীনতার ‘সপক্ষ’ শক্তির অনাচারকে আমরা সমাজের সুবিধাভোগী অংশের একাংশ লঘু করে দেখেছি, একই কাজ স্বাধীনতার ‘বিপক্ষ’ দল করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্ন তুলে হাহাকার করেছি। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির সুবিধাভোগীরাও একই ধরনের দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু জনগণ তাদের বিচার-বিবেচনা করেছে নির্মোহভাবে।
সরকারে থেকে যে দলই মানবাধিকার ও আইনের শাসন লঙ্ঘন করে গণতন্ত্রকে বিনাশ করেছে কিংবা দুর্নীতি-দলীয়করণ-দখলবাজি আর সন্ত্রাসের মাধ্যমে সম্পদ ও সুবিধা কুক্ষিগত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে জনগণ ভোট দিয়েছে। কালেভদ্রে যখনই গণতন্ত্র বিনির্মাণ, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, দারিদ্র্য বিমোচন বা কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, জনগণ তাতে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছে। জনগণই গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সাম্যের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে যুগের পর যুগ ধরে ধারণ করেছে। নেতারা ক্ষমতায় আসার জন্য বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে নানাভাবে সমর্থন করেছে, জনগণ কখনোই অসাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। নেতারা যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনো বিলম্বিত, কখনো বাধাগ্রস্ত করেছেন, কিন্তু যত দেরিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন জনগণ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছে।
জনগণের এই শক্তি, দেশপ্রেম ও আকাঙ্ক্ষাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপলব্ধি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে আরও উদার, সুখী ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা কেবল তাহলেই সম্ভব হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.