দায়মুক্তি- এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? by শেখ হাফিজুর রহমান

বিশ্বজিৎ দাস আমাদের সবাইকে অপরাধী করে চলে গেছেন মৃত্যু-পরবর্তী জগতে, জাগতিক সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্বজিতের মৃত্যু আবারও জানিয়ে গেল যে আমরা মরে বেঁচে আছি। প্রকাশ্য দিবালোকে একদল মনুষ্যরূপী হায়েনা পিটিয়ে-কুপিয়ে নির্মমভাবে বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে।
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড দেখেছি, কেউ দাঁড়িয়ে ছিলাম পাশেই, পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল ১০-১৫ গজ দূরে, আলোকচিত্রী পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন, আরও অনেকে বসে ছিলাম টেলিভিশনের সামনে। যাঁরা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁরা ছিলেন নির্বিকার। আলোকচিত্রীরা ও ভিডিওম্যানরা বিশ্বজিতের নির্মম মৃত্যুদৃশ্য ক্যামেরা ও ভিডিওতে নিখুঁতভাবে ধারণ করে তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে (!) সম্পন্ন করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সরকারি দল আজ বিব্রত, কেননা যাদের হত্যাকারী বলে শনাক্ত করা হয়েছে, তারা তাদের ছাত্রসংগঠনের কর্মী (অথবা সরকারি ছাত্রসংগঠনে অনুপ্রবেশকারী!)। বিরোধী দল আজ বিমর্ষ, কেননা বিশ্বজিৎ দাসকে দলীয় কর্মী বলে দাবি করে তারা সুবিধা করতে পারেনি। হায় বাংলাদেশ! একটা মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে রড দিয়ে পিটিয়ে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, আর আমরা পুরো জাতি তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম?
যাঁরা বিশ্বজিৎ হত্যার সময় তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের কেউই তাঁর জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যাদের ওপর নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা ১০-১৫ গজ দূরে দাঁড়িয়ে পাথরের মতো বোবা ও নিশ্চল হয়ে গিয়েছিল, ভিডিওম্যানরা বিশ্বজিতের নির্মম মৃত্যুদৃশ্য দর্শকদের জন্য ধারণ করে সুচারুভাবে তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন, ক্লিনিকের ডাক্তাররা দ্রুতগতিতে মরণাপন্ন বিশ্বজিতের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেননি, আর আমরা যারা টেলিভিশনের পর্দায় বিশ্বজিতের মৃত্যুদৃশ্য দেখে মর্মাহত হয়েছি, তারাও বিশ্বজিতের হত্যার প্রতিবাদে নেমে আসিনি রাস্তায়।
আমরা মানবিক বোধ হারিয়ে ফেলেছি, নইলে প্রকাশ্য দিবালোকে একদল দুর্বৃত্ত পিটিয়ে ও কুপিয়ে একজন নিরীহ পথচারীকে মেরে ফেলতে পারে না। ভাবি, আমারও কি যেকোনো সময় বিশ্বজিতের পরিণতি হতে পারে না? এই সমাজ ও রাষ্ট্র কি আমরা চেয়েছিলাম? যেখানে মুনাফার লোভে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভস্ম হয়ে যেতে হয় ১১১ জন পোশাকশ্রমিককে, যেখানে অসুস্থ রাজনীতির নির্মম বলি হতে হয় বিশ্বজিৎকে, যেখানে হরতালের নামে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় বাসচালককে, যেখানে বিএনপি-জামায়াত মিলে বানচাল করতে চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।

দুই.
শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসকে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে বেরোনোর পর একজন পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িতে করে তাঁকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এ খবরে অনেকের মধ্যে যে আতঙ্ক দেখেছি, তা আমাকে খুব বেশি স্পর্শ করেনি। কেননা, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে তো বিকাশের চেয়েও অনেক অনেক ভয়ংকর ব্যক্তিবর্গ বসে আছেন। বিকাশকে বা বিকাশের মতো সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে, কারাগারে আটকে রাখতে পারে, কিন্তু বিকাশকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করেন, সে পর্যন্ত যে আইন-আদালতের হাত পৌঁছায় না! বিকাশকে যাঁরা পৃষ্ঠপোষণা দেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের পোশাক এতটাই সাদা যে বাড়তি নীলের প্রয়োজনই হয় না। তাঁদের হাসিতে হূদয় বিগলিত হয়, তাঁদের বক্তৃতায় শাণিত হয় আমাদের চেতনা।
রাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের যে তালিকা প্রণয়ন করেছে, তার এক নম্বর তালিকায় যে বিকাশ কুমার বিশ্বাসের নাম, তিনি কী করে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন? তাঁর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার খবরটি কেন পুলিশ বা র্যা বের কর্মকর্তারা জানতে পারলেন না? একটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব সন্ত্রাসীদের আটকে রাখা, তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু রাষ্ট্র যদি তা করতে ব্যর্থ হয় বা সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাহলে কী করে রাষ্ট্র সন্ত্রাস দমন করবে, কী করে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে?
ভয়ংকর কোনো সন্ত্রাসীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য বা সে যেন জামিনে মুক্ত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কোনো হুমকি তৈরি করতে না পারে, সে জন্য পুলিশ ও পাবলিক প্রসিকিউটরদের তৎপর হতে হয়। পুলিশ যদি ঠিকঠাকভাবে অপরাধের তদন্ত করে এবং পাবলিক প্রসিকিউটররা যদি নিষ্ঠার সঙ্গে তৎপর থাকেন, তাহলে অপরাধীদের পক্ষে শাস্তি এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের দেশের পুলিশ একে তো দুর্নীতিগ্রস্ত, তার ওপর রয়েছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নানা চাপ। ফলে অপরাধের তদন্তই ঠিকভাবে হয় না। ওদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটররা দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ। ফলে ১০০টি অপরাধ মামলার বিচারে গড়ে ১০-১৫ জন অপরাধী শাস্তি পায়। বাকি ৮০ থেকে ৮৫ জন অপরাধী শাস্তি পায় না। ফলে অপরাধীরা উৎসাহিত হয় এবং অপরাধ করার সংখ্যা যায় বেড়ে। আবার ভয়ংকর অনেক সন্ত্রাসীর জামিনের বিরোধিতায় পাবলিক প্রসিকিউটররা তৎপর থাকেন না বা সংশ্লিষ্ট আদালতও সতর্ক থাকেন না। ফলে অনেক সন্ত্রাসী জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে মামলার আলামত নষ্ট করে, সাক্ষীদের ভয় দেখায় এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
আমাদের ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম’ বা ফৌজদারি ন্যায়বিচার-ব্যবস্থা প্রায় অকার্যকর একটি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে আমরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারি না। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কীভাবে জামিনে মুক্ত হলেন, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর বিকাশ কীভাবে পুলিশ ও র্যা ব প্রশাসনের অগোচরে নিরাপদ গন্তব্যে চলে গেলেন, সেই দায়দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

তিন.
বিকাশের মুক্তি পাওয়ার পর বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী উদ্বেগ প্রকাশ করলেন এবং তীব্র ভাষায় সরকারের সমালোচনা করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, রুহুল কবির রিজভী যখন বিকাশের মুক্তি দেওয়ায় সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, টেলিভিশনের পর্দায় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে তাঁর চারপাশে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের কেউ কেউ সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত। আমরা যখন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আমি ও আমার বন্ধুরা ওই ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করতে দেখেছি। মনে পড়ছে আরেকটি ঘটনার কথা। ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে রুহুল কবির রিজভী সেবার জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি হন, তাঁর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইলিয়াস আলী। নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার কিছুদিনের মাথায় সন্ত্রাসের অভিযোগে ছাত্রদলের ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয় এবং বিএনপি সরকারের পুলিশ ভেঙে দেওয়া ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।

চার.
মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম একটি সুষম ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা এমন রাষ্ট্র চাইনি, যেখানে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করবে বিশ্বজিৎ দাসকে, আমরা এমন রাষ্ট্র চাইনি, যেখানে বিকাশের মতো সন্ত্রাসী মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে, আমরা এমন রাষ্ট্র চাইনি, যেখানে যুদ্ধাপরাধী নিজামী ও মুজাহিদের গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে বাংলাদেশের পতাকা।
 শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধবিজ্ঞান গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.