২০ হামলাকারীর তালিকা করেছে জবি প্রশাসন

বিশ্বজিতের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে যারা হত্যা করেছে- এমন ২০ জনকে শনাক্ত করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১৫ জনের তালিকা প্রস্তুত করে উপাচার্যের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তাদের বহিষ্কারের প্রক্রিয়া চলছে। এর আগে অন্য পাঁচজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের কাছে এ তালিকা হস্তান্তর করবে বলে জানা গেছে।
এদিকে ছাত্রলীগের গ্রেপ্তার হওয়া কর্মীদের দেওয়া তথ্য ও তদন্তে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১৪ জনকে শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শনাক্ত হওয়া অন্য আটজনসহ ছাত্রলীগের ২৭ কর্মী বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর পলাতক। তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছে ডিবি পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন ও ডিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের অভিযুক্ত কর্মীদের গ্রেপ্তারে পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত ১৫ জনের তালিকা উপাচার্যের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে প্রশাসন এ তালিকা তৈরি করেছে। তালিকাভুক্তরা হলো জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, রাজন তালুকদার, আজিজুল হক, ইউনুস আলী, আবদুল্লাহ আল মামুন, আলাউদ্দিন, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিয়া টিপু, মোশারফ, কালা সুমন, সজীব, সোহেল, শিপলু, আল-আমিন ও সঞ্জীব বসাক।
তালিকা করা ও ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যে দুই ছাত্রের সনদ বাতিল ও তিনজনকে আজীবন বহিষ্কার করেছি। আরো কিছু ছাত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বজিৎ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
৯ ডিসম্বের ঘটনার পর ১১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাহফুজুর রহমান নাহিদ, রফিকুল ইসলাম শাকিল, মীর নুরে আলম লিমন, ইমদাদুল হক ও ওবায়দুল কাদের তাহসিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
১৪ জন শনাক্ত : ডিবি পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ, গণমাধ্যমের ছবি ও তদন্তে মোট ৩৩ জনের নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে ১৪ জনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে ডিবি। শনাক্ত হওয়া ওই ১৪ ব্যক্তির মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও ডিবির উপকমিশনার (ডিসি) মনিরুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, ১৪ জনের জড়িত থাকার ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত ছয়জনই গ্রেপ্তার আছে।
ছাত্রলীগের শনাক্ত হওয়া কর্মীদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম, এইচ এম কিবরিয়া ও কাইউম মিয়া টিপুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়া পলাতকরা হলো মীর নুরে আলম লিমন, রাজন তালুকদার, ইমদাদুল হক, ওবায়দুল কাদের তাহসিন, আজিজুল হক, ইউনুস আলী, আবদুল্লাহ আল মামুন, সজীব, সোহেল, শিপলু, আল-আমিন উজ্জ্বল, আলাউদ্দিন, মোশারফ ও সুমন। সৈকত, মোস্তফা, রিন্টু, পাভেল, সরল, মিরাজ, রুদ্র, কামরুল, মিনহাজ, সুমন পারভেজ, মুন্না, রাসেল ও তমাল ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের ব্যাপারে খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী লোকজন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক তাজুল ইসলাম জানান, যারা ওই দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
হামলার বর্ণনা : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর আট দিনের রিমান্ডে থাকা ছয় আসামি ডিবি পুলিশের কাছে দফায় দফায় এলোপাতাড়ি কোপানো ও পিটিয়ে জখম করার কথা স্বীকার করেছে। বিশ্বজিৎকে তারা দলবেঁধে আঘাত করে। প্রথমে শাকিল, রাজন, ইমদাদ ও ইউনুস গ্রুপ। পরে হামলা চালায় লিমন, নাহিদ, তাহসিন, সৈকত, সোহেল, সজীবসহ অন্যরা। মারধরের দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে তাদের সমস্যা নেই- ভেবে সাংবাদিকদের ছবি তুলতেও বাধা দেয়নি তারা।
নাহিদ, শাকিল, শাওন, সাইফুল, কিবরিয়া ও টিপু পুলিশকে জানায়, শাকিলের কাছেই চাপাতি ছিল। ছুরি নিয়ে ভিক্টোরিয়া ক্লিনিকের ওপর ওঠে রাজন। সিঁড়িতে প্রথমে রাজনই বিশ্বজিৎকে ছুরিকাঘাত করে। পরে শাকিলও কোপ দেয়। রাজনের ছুরিটি তার কাছ থেকে নিয়ে আরো দু-একজন জখম করে বিশ্বজিৎকে। তবে এসব হামলাকারীর নাম বলতে পারেনি তারা। বিশ্বজিতের ওপর হামলার কারণ হিসেবে আসামিরা পুলিশকে বলছে, নেতাদের খুশি করতেই তারা এ হামলা চালায়। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর অভিযুক্ত ও বহিষ্কার হওয়া কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে। পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে যারা মরিয়া ছিল তারাই বিশ্বজিৎকে মেরেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিবি সূত্র জানায়, ৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিতের ওপর হামলার সময় রাজন প্রথমে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। পরে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে শাকিল। লিমন ও তাহসিন রড দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করে বিশ্বজিৎকে। ইউনুস মোটা লাঠি দিয়ে আঘাত করে। নাহিদের হাতে ছিল একটি ধারালো রড। সম্প্রতি এক সংঘর্ষের সময় নাহিদ কবি নজরুল কলেজ থেকে ওই রডটি সংগ্রহ করে। শাওন, সোহেল, আল-আমিন উজ্জ্বল, আলাউদ্দিন, আজিজুল, মামুন, শিপলু, সুমনসহ অন্তত ১৫ জনের হাতে রড ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদে শাকিল দাবি করে, রাজন, ইউনুস ও মোস্তফা এক বা একাধিক ছুরি দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়। বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নেওয়ার পর পরই মৃত্যুর খবর পায় শাকিল। তখন সিনিয়র নেতাদের নির্দেশে রক্তমাখা শার্ট খুলে ড্রেনের মধ্যে ফেলে দেয় সে। চাপাতিও লুকিয়ে ফেলে শাকিল। চাপাতিটি তার নিজের। অনেক দিন ধরে চাপাতি তার কাছে সব সময় থাকে। শাকিল দাবি করে, পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সে হামলা চালায়।

No comments

Powered by Blogger.