পুলিশ ও চিকিৎসকদের অবহেলার অভিযোগ by এস এম আজাদ

'আমি রাজনীতি করি না। গণ্ডগোলে ছিলাম না। আমি হিন্দু মানুষ। সামনেই আমার কাপড় সেলানোর দোকান। ভাই, আমারে বাঁচান'- এভাবে আকুতি করে-ছিলেন বিশ্বজিৎ দাস। রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা বিশ্বজিতের এ বিলাপ রিকশাচালক রিপনের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল।
বিশ্বজিতের অবস্থা দেখে কয়েক পথচারীরও মায়া হয়েছিল। তাঁরাই হাসপাতালে নেওয়ার জন্য রিপনের রিকশায় তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বজিৎকে। পুরান ঢাকার গলিপথে রিপন ছুটে চলেন মিটফোর্ড হাসপাতালের দিকে। তিনি বিশ্বজিৎকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, 'ভাই, এই তো চইলা আইছি।' কিন্তু তখন আর বিশ্বজিতের সাড়া মেলেনি। দ্রুত হাসপাতালে গেলেও লাভ হয়নি রিপনের। উল্টো বিপদে পড়েন তিনি। চিকিৎসকরা বিশ্বজিৎকে 'শিবির' ও 'পুলিশ কেসের' রোগী বলে মন্তব্য করেন। 'গণ্ডগোলের' রোগী আনার অপরাধে রিপনকেও আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাঁরা। ২০ মিনিট পর রোগীকে দেখে জানালেন, তিনি মারা গেছেন। আর বিশ্বজিতের ভাই উত্তমের হস্তক্ষেপে ছাড়া পান রিপন। কালের কণ্ঠের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রিপন বলেন, 'আরকেটু আগে চিকিৎসা করলে মানুষটা বাঁচতেন। পুলিশের লোক ওখানেই আছিল। হেরা কেউ তারে তো সাহায্য করে নাই।' ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, জখমের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানকালে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানিয়েছে, বিশ্বজিৎ দাসকে ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও রড দিয়ে আঘাত করে হত্যা করছিল, তখন ঘটনাস্থলের প্রায় ১৫ গজ দূরেই ছিলেন লালবাগ জোনের উপকমিশনার হারুন-উর-রশিদ। পাশেই ছিলেন কোতোয়ালি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিকসহ পুলিশের কয়েক কর্মকর্তা। জনসন রোডের রাস্তার বিপরীত দিকে অর্থাৎ যে পাশে ঘটনা ঘটে এর ১৫-২০ গজ দূরে ছিল সূত্রাপুর থানার দুটি দল। একটু দূরেই ছিলেন থানার তৎকালীন ওসি নজরুল ইসলাম। বিশ্বজিতের ওপর হামলার আগে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আইনজীবীদের মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগের ওই বেপরোয়া কর্মীরা।
বিশ্বজিতের ওপর হামলা এবং তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ও চিকিৎসকদের অবহেলার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনেও ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অবহেলার ব্যাপারটি খতিয়ে দেখতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রুবেল হোসেনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। অন্যদিকে অবহেলার অভিযোগে সূত্রাপুর থানার ওসি নজরুল ইসলামকে শাস্তিমূলক বদলি করা হলেও লালবাগের ডিসি হারুন-উর-রশিদ আছেন বহাল তবিয়তে। কথিত আছে, সরকারের উচ্চমহলে ব্যাপক ক্ষমতাধর এই ডিসি।
ডিসি হারুনের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ এবং ব্যবস্থা গ্রহণের প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, 'ঘটনা ঘটেছে সূত্রাপুর থানা এলাকায়। ওই থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। লালবাগে ঘটনা ঘটেনি তাই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।'
পুলিশের ভূমিকা : প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন জানায়, ঘটনাস্থলের ১৫ গজ দূরে অনেক পুলিশ ফোর্স ছিল। আহত বিশ্বজিৎ রাস্তায় পড়ে থাকলেও পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেনি। অথচ পুলিশের প্রতি নিহত ও আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নেওয়ার নির্দেশ আছে।
বিশ্বজিতের ভাই উত্তম কুমার দাস অভিযোগ করে জানান, পুলিশ এগিয়ে গেলে বিশ্বজিৎকে এভাবে প্রাণ দিতে হতো না।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সিনিয়র সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন আনু, সহসাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু জাফর সিকদার মানিক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক সৈয়দা শাহিন আরা লাইলী, সদস্য অ্যাডভোকেট এখলাস উদ্দিন ভুঁইয়া, আবদুস সোবহান, জিয়াউদ্দিন জিয়াসহ কয়েক আইনজীবী প্রায় একই ভাষায় বলেন, পুলিশ দর্শকের মতো পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের লেলিয়ে দেয়। কোর্ট-কাচারি ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় ওই দিন শত শত পুলিশ ছিল। এর মধ্যে ছাত্রলীগের কর্মীরা সাত আইনজীবীকে পেটানোর পর তারা বিশ্বজিৎকে হত্যা করল।
কয়েকজন অভিযোগ করে, ঘটনাস্থলের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে লালবাগ জোনের ডিসি ও কোতোয়ালি থানার ওসি হামলাকারীদের উসকানি দিয়েছেন। অথচ শাস্তিস্বরূপ বদলি হয়েছেন সূত্রাপুর থানার ওসি। গত বছরের ৬ জুলাই হরতালের সময় মানিক মিয়া এভিনিউতে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলা চালান এই ডিসি হারুন। ঘটনার পর তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ডিসি থেকে এসপি বানানো হয়েছে। সূত্র জানায়, জনসন রোডের দুই পাশ কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর থানার আওতাধীন। দুই থানার আওতা এ সীমারেখায় লালবাগ ও ওয়ারী জোনেও ভাগ হয়ে গেছে। বিশ্বজিৎকে যে ক্লিনিকের বারান্দায় কোপানো হয়েছে সেটি সূত্রাপুরে হলেও হামলা ও ধাওয়ার বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে কোতোয়ালি অংশে। তিনি ধাওয়া খেয়ে কোতোয়ালি অংশে গিয়েই আশ্রয় নেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লালবাগ জোনের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন-উর-রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুরো ঘটনাই ঘটেছে সূত্রাপুর থানা এলাকায়। সেখানে সূত্রাপুর থানার কিলো ও সিরা নামের দুটি মোবাইল টিম ছিল। আমি ছিলাম কোর্ট-কাচারি এলাকায়। সেখান থেকে বিশ্বজিৎকে যেখানে কোপানো হয়েছে সে অংশটা দেখা যায় না।' কোতোয়ালি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিকী অবশ্য বলেন, 'ঘটনার সূত্রপাত কোতোয়ালি এলাকা থেকে, তবে ঘটেছে সূত্রাপুর এলাকায়। আইজীবীদের ওপর হামলাও হয় সূত্রাপুরে!'
চিকিৎসকদের অবহেলা : রিকশাচালক রিপন জানান, মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়ার পর স্টাফ ও চিকিৎসকরা জানতে চান, রোগী কিভাবে আহত হলেন? রিপন তাঁদের বলেন, 'মিছিল করার সময় মনে হয় তাঁকে মারধর করছে।' এ কথা শুনে চিকিৎসকরা 'শিবির' ও 'পুলিশ কেসের' রোগী রিপন কেন আনলেন, তা জানতে চান। সকাল সোয়া ৯টার দিকে হাসপাতালে যান রিপন। দীর্ঘ সময় রিপনকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন চিকিৎসকরা। অন্তত ২০ মিনিট পর বিশ্বজিৎকে অন্য একটি কক্ষে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে চিকিৎসকরা জানান, বিশ্বজিৎ মারা গেছেন। বিশ্বজিতের বড় ভাই উত্তম কুমার দাস বলেন, রিকশাচালককে আটকে সেখানে কর্তব্যরতরা পুলিশ কেসের রোগী তিনি এনেছেন কেন- জানতে চেয়েছেন। এ নিয়ে তর্কবিতর্কে কেটে গেছে প্রায় ২০ মিনিট। বারবার অনুরোধ করলেও নানা রকম কথাবার্তায় দেরি করা হয়েছে। এ সময় কয়েক চিকিৎসক 'শিবিরকর্মী'কে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না বলেও উল্লেখ করেন!
হাসপাতালের নথিপত্রে দেখানো হয়েছে, জরুরি বিভাগে বিশ্বজিৎকে ভর্তি করা হয় ৯টা ৩০ মিনিটে। ক্যাজুয়ালটি ব্লকে রোগী গ্রহণের সময় ৯টা ৩৫ মিনিট। জরুরি বিভাগে চিকিৎসক ডা. সহদেব রাজবংশীর দায়িত্ব থাকলেও যথাসময়ে কর্মস্থলে পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ায় দায়িত্ব পালন করছিলেন রাতের পালার চিকিৎসক ডা. হাফিজুর রহমান মিয়া। বিশ্বজিৎকে আনার কিছুক্ষণ পর হাসপাতালে পৌঁছান ডা. সহদেবও। তাঁরা দুজনই কালের কণ্ঠের কাছে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তাঁরা যথাসময়ে চিকিৎসা দিয়েছেন।
জরুরি বিভাগ থেকে বিশ্বজিৎকে নেওয়া হয় ক্যাজুয়ালটি ব্লকে। ওই সময় দায়িত্বে ছিলেন সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. তানভীর সিদ্দিকের নেতৃত্বে ডা. ইমতিয়াজ, ডা. নিজাম উদ্দিন ও ইন্টার্নি চিকিৎসক ডা. প্রসেনজিৎ, ডা. রিমা ও ডা. মৌসুমী আক্তার। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. তানভীর বলেন, ক্যাজুয়ালটিতে আনার পর কোনো অবহেলা করা হয়নি। বিশ্বজিৎ শকে চলে যান। তাঁর ব্লাড প্রেসার পাওয়া যাচ্ছিল না। তাৎক্ষণিকভাবে ইনজেকশন কাটসন, হার্টম্যান স্যালাইন, ইনজেকশন ডাইক্লোফেনাক ও রেনিটিডিন দেওয়া হয়েছিল। প্রচুর রক্তক্ষরণ ও ভয়াবহ আঘাতের কারণে সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। ৯টা ৫৫ মিনিটে বিশ্বজিৎকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তদন্তে রেডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রুবেল হোসেন, আবাসিক সার্জন (জেনারেল) ডা. ওমর ফারুক ও ডা. ফিরোজকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কমিটির প্রধান গতকাল সকালে চিঠি পেয়েছেন। কমিটিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
জানতে চাওয়া হলে মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির হাসান তদন্ত কমিটি গঠনের সত্যতা নিশ্চিত করেননি। তবে তিনিই বলেন, 'অবহেলা হলে তদন্ত করে দেখা হবে।'

No comments

Powered by Blogger.