মধ্যবিত্তের যানজট অশ্লেষা by শওকত আলী

নুরুন্নবী আমার পাশের বাসায় অবসরপ্রাপ্ত বাবাকে নিয়ে বাস করেন। পাঁচজনের সংসারে নুরুন্নবীই প্রধান। সিনিয়র হিসাবরক্ষক। প্রতিদিন মিরপুর থেকে যানজটের সঙ্গে যুদ্ধ করে মতিঝিলে অফিস করেন। প্রাইভেট কোম্পানি বলে প্রশাসনে কড়া নজরদারি।
গড়ে তিন দিন লেটমার্ক হলে এক দিনের বেতন কাটা যায়। নুরুন্নবীও এর আওতাভুক্ত।
আমি এই নির্মম বাস্তবতার কোনো সমাধান দিতে পারিনি। বললাম, হাতে আর একটু সময় নিয়ে বের হলেও কি এমন হয়? উত্তরে বলেন, প্রায় দুই ঘণ্টা হাতে রেখে বের হই। একটি লাল বাতির সিগন্যাল ওই অফিস টাইমে কত বড় জল্লাদ, তা কী করে বোঝাই। ট্রাফিক হাত তুললে সীমারের হাত বলে মনে হয়। এরপর যদি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বা অন্য কোনো ভিআইপি ব্যক্তি ওই সময় একবার যাতায়াত করেন, তবে সেদিন লেটমার্ক অবশ্যম্ভাবী। আমি আবার বলি, আপনার পরামর্শ কী? নুরুন্নবী বলেন, অফিস টাইমে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হেলিকপ্টার ব্যবহার করলেই এমনটি হবে না। কয় টাকারই বা তেল পুড়বে? কিন্তু যে ক্ষতিটা রাস্তার হাজার হাজার মানুষ ভোগ করে, সেটা তো বন্ধ হবে! আমার এক দিনের বেতন পরিবারের জন্য কত তীব্র প্রয়োজন মেটায়, তা আমরাই বুঝি।
নুরুন্নবী ‘লেটকামার’ শব্দটি তাঁর জীবন থেকে কীভাবে মুছে দেবে? কতভাবে কত কৌশলে অফিস-যাত্রার পরিকল্পনা করেছে। তীব্র যানজটে কোনোটাই কাজে আসে না। লোকাল বাসে উঠলে সারা রাস্তায় যাত্রী ওঠানামার বাণিজ্য, দুই টাকা কমের জন্য সেখানে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে কী ভয়ানক কুস্তাকুস্তি। মতিঝিল স্টপেজে নেমে গায়ের জামা-জুতার ছিরি দেখে মনে হয় কোনো ধোলাই খাওয়া পকেটমার বুঝি! একটু চড়া ভাড়ায় সিটিং সার্ভিস নামের বাসগুলোতে উঠতে গেলেও রিলিফের লাইন ধরতে হয়। প্রতি স্টপেজে পাঁচজনের বেশি তারা যাত্রী ওঠায় না। এতে পোশাক রক্ষা পেলেও লাইনে সময় খেয়ে ফেলে। একজন বেশি উঠতে গেলে বাসের হেলপার বুকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়। মুক্তির ফর্মুলা নুরুন্নবী খুঁজে পান না। এক দিন আমরা একই সঙ্গে বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে। বললাম, অনেক ফ্লাইওভার হচ্ছে, শুভদিন আসছে। যেন মাইক্রোওভেন থেকে উত্তর বেরিয়ে এল, ‘ঢাকার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা ওই সব ফ্লাইওভারে বছরে কয় দিন চড়তে পারবে? তাঁরা যে যানবাহনে চলাচল করে তা তো ওই ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলে না।’
ঢাকায় দালানবাড়িতে ভাড়া থাকে বলে নুরুন্নবী কি মধ্যবিত্ত? বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক বাস্তবতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধারণাটির তাত্ত্বিক ভিত্তি নড়বড়ে, ভঙ্গুর। ঢাকায় এখন হাজার হাজার শিক্ষিত নুরুন্নবীর মতো লাঞ্চ না খেয়ে, জীবন বাজি রেখে বাঁচার লড়াই করছে। শ্রেণী ধারণার যিনি পুরোধা, তাঁর সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম জ্ঞান পেয়েছিলাম রাজনৈতিক বন্ধুবর ইমতিয়ার শামীমের কাছে। কার্ল মার্ক্স তো উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের সম্পর্কের ভিত্তিতেই দুটি শ্রেণীর কথা বলেছিলেন, শাসক শ্রেণী ও শোষিত শ্রেণী। কিন্তু ম্যাক্স ভেইবার মধ্যবিত্তদের ‘মধ্যবর্তী’ শ্রেণীর পক্ষে সমাজে নতুন বিতর্ক এনে দিলেন। যাঁরা উৎপাদন-পদ্ধতির মালিকও নন আবার শ্রমও বিক্রি করেন না, তাঁরা কোন শ্রেণীতে পড়বেন? বিষয়টি সমাধানের জন্যই নাকি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধারণাটি গজিয়েছে! বাংলাদেশের শোষিত শ্রেণী আসলে মধ্যবিত্তের ছায়া দেখে। মধ্যবিত্ত হতে পারে না। শত শত রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিমালিকের কাছে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিচেতনাতেই আজকের গর্বিত পোশাকশিল্প। চেতনার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্যদের মার্ক্সের দুটি শ্রেণীর যেকোনোটিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। নুরুন্নবী কিন্তু বলেছে, ছোট দুটি বোনের জন্য, নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাঁদের মধ্যবিত্ত সেজে থাকতে হয়।
যানজট নিরসনে সরকার আসলে কাদের কথা শুনছে? নব্য ধনিকশ্রেণীর গাড়িতে একটি ঘষা লাগার যে কষ্ট বেদনা আর নুরুন্নবীর মতো নকল মধ্যবিত্তের যানজট নাকালে বেতন কর্তন হয়ে যাওয়ার হাহাকার, এর মধ্যে কোনটার মেরিট বেশি? ঘুরেফিরে প্রাইভেট গাড়িতে ঘষা লাগার বিষয়টিই প্রধান। যে জন্য তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ফ্লাইওভার নির্মাণের যুক্তিতে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে বাংলাদেশে বিএমডব্লিউ গাড়ি নিরাপদে চলতে পারবে।’ অর্থাৎ সরকার মধ্যবিত্তের জন্য উন্নত গণপরিবহন নয়, পুঁজিবাদের ব্যক্তিচেতনাতেই ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ করছে।
নুরুন্নবী গণিতে খুবই ভালো। অফিস সহকর্মীর সুবাদে নয়াপল্টনে পাওয়া তিন হাজার টাকার একটি টিউশনি শেষ করে রাত নয়টা বেজে যায়। সেখান থেকে ক্লান্ত দেহে বাসে উঠেই উবু হয়ে নুয়ে পড়ে ভেজা তেলকাষ্টা গন্ধের সামনের সিটের ওপর। তেলকাষ্টার উৎকট গন্ধ নাকে সয়ে গেছে। তীব্র যানজটের মধ্যেও ওই সিট ধরে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আধো আধো ঘুমিয়ে কী মধুর শ্রান্তি। ঘুমঘোরে বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে সারি সারি প্রাইভেট কার ছুটে চলছে। কোনো গাড়িতে সুনীলের কবিতার সেই ফরসা রমণীরা হয়তো গোসলরত নয়, নগরে তারা মেকআপরত। কখনো ভাবে পথের পাঁচালী ছবির অপুর সেই রাঙতা দিয়ে মুকুট বানিয়ে নকল রাজপুত্র সাজবার। আহারে, আমার যদি এমন একটি এসি গাড়ি থাকত!
মধ্যবিত্ত হওয়ার অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা আর মোহের ঘোর কাটিয়ে দেয় বাসের হেলপার। স্যার, বাস ১২ নম্বর যাইব না, গ্যাস নাই! আপনারা ১০ নম্বরে নাইমা যান। যাত্রীসংখ্যা কম, দু-একজন নিচু স্বরে গড়গড় করে ফকিন্নির বাচ্চা, হারামজাদা-বাটপার বলে নেমে যান। রাত সাড়ে ১১টায় আবারও লোকাল বাস বদলিয়ে মিরপুর পল্লবীতে পরিবারের কাছে ফিরে আসে ‘মধ্যবিত্ত-মধ্যবর্তী’ নুরুন্নবী। তাঁর মূল পরিচয় গবেষকদের যে সংজ্ঞাতেই পড়ুক না কেন, পরদিন তো একই যানজট, সংগ্রাম তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
 শওকত আলী: সমন্বয়কারী, বদলে যাও বদলে দাও মিছিল।
shawkat1404@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.