গণিতবিদ রামানুজন by এম শামসুর রহমান

সময়টা ১৯১৩ সাল। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্ট অফিসে হিসাব বিভাগের বার্ষিক ২০ পাউন্ড বেতনের সামান্য করণিক (ঢ়বঃঃু পষবৎশ)। দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। ২৪ বছরের তরুণ। ঋরৎংঃ অৎঃং (বর্তমানের উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন (১৯০৬)।
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। স্নাতক, মাস্টার্স পর্যায়ের ধারেকাছেও আসতে পারেননি। এমনি নিষ্প্রভ তার শিক্ষাগত যোগ্যতা। তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন ১৯০৯-এ। কালক্রমে করণিকের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে 'প্রখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ রামানুজন' হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। পুরো নাম শ্রীনিবাস রামানুজন (ঝৎরহরাধংধ জধসধহঁলধহ)। বিশ শতকের গণিতচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। এ উপমহাদেশের এক বিস্ময়কর প্রতিভা।
বাল্যে রামানুজনের সৃজনশীল মেধার বিকাশ ঘটে। চাকরির অবসর সময় তিনি গণিতচর্চায় মনোনিবেশ করতেন। একনিষ্ঠ গণিতসাধক হলেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। হিসাব করার বুদ্ধিমত্তা অসাধারণ। বড় বড় গুণ তিনি দ্রুত সম্পন্ন করতে পারতেন। স্কুলজীবনে এ. ঝ. ঈধৎৎ-এর ঝুহড়ঢ়ংরং ড়ভ ঊষবসবহঃধৎু জবংঁষঃং রহ চঁৎব ধহফ অঢ়ঢ়ষরবফ গধঃযবসধঃরপং বই থেকে গণিতের নব নব তথ্য সম্পর্কে তার জ্ঞান আহূত হতে থাকে। ১৯১১ সালে ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব ওহফরধহ গধঃযবসধঃরপধষ ঝড়পরবঃু-তে রামানুজনের প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই জার্নালে পরের বছর তার আরও দু'তিনটি পেপার বেরিয়েছে।
রামানুজন শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে উচ্চতর গবেষণার প্রত্যাশায় তৎকালীন কেমব্রিজের নামজাদা প্রফেসর এ. ঐ. ঐধৎফু-কে (১৮৭৭-১৯৪৭) ১৯১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রথম চিঠি লেখেন। একজন অখ্যাত, অজ্ঞাত করণিকের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে হার্ডির ধারণা জন্মাল, পত্রলেখক যুবক হয় 'বদ্ধপাগল' নতুবা 'প্রতিভাবান'। পরে তার শেষের ধারণাই সত্যি হলো। যুবকটির অনন্যসাধারণ প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়ে তার গবেষণা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে হার্ডি তাকে আমন্ত্রণ জানালেন কেমব্রিজে। অবশেষে নানা প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে ১৯১৪ সালে তিনি বিলেত যান। পাঁচ বছর সেখানে অবস্থানের পর ১৯১৯-এ রামানুজন দেশে ফিরে আসেন। হার্ডির অধীনে গবেষণাকর্মের সুযোগে রামানুজন সংখ্যাতত্ত্ব, বিভাজনতত্ত্ব এবং অবিচ্ছিন্ন ভগ্নাংশে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। গণিতের এসব অপরিহার্য বিষয় অপরিমেয় অবদানে সমৃদ্ধ করে তোলেন। এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলে রামানুজন নিয়ে লেখা যেন অপূর্ণ থেকে যায়। তিনি গোঁড়া নিরামিষাশী ছিলেন। একটি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন রয়েছেন (১৯১৮)। হার্ডি রামানুজনকে দেখতে যাবেন। পথে তার ট্যাক্সিটি হঠাৎ করে বিকল হয়ে পড়ে। প্রফেসর হার্ডির তাই নার্সিংহোমে পেঁৗছতে দেরি হয়। এ জন্য তিনি রামানুজনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এবং বলেন, ট্যাক্সিটির নম্বর অশুভ হওয়ায় এমনটি ঘটল। রামানুজন জানতে চাইলেন, ট্যাক্সির নম্বর কত। হার্ডি বললেন, ১৭২৯। রোগশয্যায় শায়িত রামানুজনের হার্ডিকে তাক লাগানো তাৎক্ষণিক মন্তব্য : এটা মোটেই অশুভ সংখ্যা নয়। ১৭২৯ হচ্ছে ক্ষুদ্রতম সংখ্যা, যাকে দুটি সংখ্যার ঘন-এর সমষ্টিরূপে দু'ভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে। অর্থাৎ ১৭২৯=১৩ + ১২৩ = ৯৩+১০৩। হার্ডি রামানুজনের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচেতনার বিকাশ দেখে তাকে খ. ঊঁষবৎ (১৭০৭-৮৩) ও ক. ঔধপড়নর-এর (১৮০৪-৫১) সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি জধসধহঁলধহ শীর্ষক একটি বই প্রণয়ন করেন (১৯৪০)। হার্ডির সহকর্মী ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ঔ. ঊ. খরঃঃষবড়িড়ফ-এর (১৮৮৫-১৯৭৭) মন্তব্য : প্রত্যেক ধনাত্মক সংখ্যাই রামানুজনের ঘনিষ্ঠ বল্পুব্দ!
রামানুজন প্রথম ভারতীয়, গণিতের সাধনা ও গবেষণায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যিনি লন্ডন জড়ুধষ ঝড়পরবঃু-এর ঋবষষড় িনির্বাচিত হলেন (১৯১৮)। একই বছরে কেমব্রিজ ট্রিনিটি কলেজেরও ফেলোশিপ লাভের গৌরব অর্জন করেন তিনি। ১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর এই খ্যাতিমান গণিতবিদ মাদ্রাজ প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রকৃত জ্ঞানতাপসের মধ্যেই অকপট স্বীকৃতি সম্ভব। রামানুজন সম্পর্কে তাই হার্ডির নিঃসংকোচ উচ্চারণ : ও ংঁপপববফবফ, ঃযড়ঁময ড়নারড়ঁংষু ও ষবধৎহঃ ভৎড়স যরস সঁপয সড়ৎব ঃযধহ যিধঃ যব ষবধৎহঃ ভৎড়স সব. চরম দারিদ্র্য ও জীবনের বৈরী পরিবেশের সঙ্গে অনবরত সংগ্রাম করা একজন করণিক প্রাতিষ্ঠানিক 'স্বল্পশিক্ষা' নিয়ে গণিতজগতে এক বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন। এ যেন আমাদের জন্য এক 'বড় শিক্ষা'।
১৯২০ সালের এই দিনে মাত্র ৩২ বছর বয়সে দুরারোগ্য যক্ষ্মা রোগে তিনি মারা যান। এই অমর গণিত শিল্পীকে বাংলাদেশ গণিত সমিতি, আমি সভাপতি থাকাকালে, ৯০তম মৃত্যুদিবসে এক স্মরণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেছে এবং নিবেদন করেছে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
আজ ২৬ এপ্রিল। রামানুজনের ৯১তম মৃত্যুবার্ষিকী। মহান এই গণিত সাধকের প্রতি রইল আমাদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
প্রফেসর এম শামসুর রহমান : সাবেক গণিত শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.