আজগুবি গল্পঃ ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস!

নাসাসহ বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষ পণ্ডিতদের মতো ভারতের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ ডিপি দুরাইও আগামী ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে কথিত ‘মায়া ভবিষ্যৎবাণী’কে কল্পকাহিনী বলে উড়িযে দিয়েছেন।
তার মতে, আগামী শুক্রবারের (২১ ডিসেম্বর, ২০১২) দিনটিও অন্যান্য দিনগুলোর মত একটি সাধারণ দিন হবে।

কলকাতার এমপি বিরলা তারামণ্ডলের পরিচালক ও নাসা এজুকেটর দুরাই বলেন, এবারের ২১ ডিসেম্বরকে একটু অন্যভাবে দেখা যায়। এই দিনটি হবে শীত সংক্রান্তির দিন (উত্তরায়ন), এদিনে সূর্য পৃথিবী থেকে তার অবস্থানের সর্বদক্ষিণতম বিন্দুতে থাকবে আর দিনটি হবে বছরের সবচেয়ে ছোট দিন। তবে এদিন পৃথিবী ধ্বংস হবে না।

পেছনের কথা 
১৯৯৫ সালে ন্যান্সি লিয়েডার নামে এক মার্কিন নারী দাবি করলেন, তার সঙ্গে ভিনগ্রহের ধূসর এক ধরনের প্রাণীর যোগাযোগ হয়েছে যাদের নাম জেটাস। তিনি তার দাবির পক্ষে একাধিক বইও প্রকাশ করেন। বিরাজমান ইউএফও (আনআইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট) তত্ত্বের সঙ্গে তাল রেখে ওইসব বইয়ে ভিনগ্রহবাসী অ্যালিয়েনদের সঙ্গে তার কথিত নানান অভিজ্ঞতার বয়ান দেন তিনি। নিজের ওয়েবসাইট জেটাটক-এ তিনি ব্যাপক প্রচারও চালান এ বিষয়ে। তার এসব ধারণার বেলুনে হাওয়া দিলেন বেটি এবং বার্নি হিল নামে আরও দু’জন। তারা ‍দাবি করলেন, অ্যালিয়েনরা তাদের অপহরণ করেছিল। এসময় লিয়েডার জানালেন, তিনি অনুমান করছেন ২০০৩ সালে ‘এক্স’ নামের একটি গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষ হবে।

তবে তার ভবিষ্যৎবাণী মোতাবেক কিছুই হলো না ২০০৩ সালে। কিন্তু এতেও দমলেন না ওই নারী। তিনি তার ভবিষ্য‍ৎবাণীতে সংশোধনী এনে জানালেন, এ ঘটনা ঘটবে ২০১২ সালে। সে মোতাবেক এরই মধ্যে ছাপা হওয়া তার বইগুলো সংশোধন করে পুনর্মুদ্রণ করা হলো। বোঝাই যাচ্ছে লিয়েডার বুজরুকি করছিলেন।

এখন প্রশ্ন হলো, লিয়েডার কেন তার ভবিষ্যৎবাণীর তারিখ বদলে ২০১২ করলেন? এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। যেমন,
•    স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের বেশ কয়েকটি গ্রহ এ বছরের একটি সময়ে একই সরল রেখায় অবস্থান করবে
•    এ বছর ২১ ডিসেম্বর মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডারের মেয়াদকাল শেষ হবে। [মায়া সভ্যতার বর্ষপঞ্জিতে ২১ ডিসেম্বরের পর আর কোনো দিনের অস্তিত্ব নেই। তাই আশঙ্কাপ্রিয় অনেকেই আশঙ্কা (আশা) করছেন, ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হতে যাচ্ছে। এই কল্পকাহিনীর সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে, সেদিন উত্তর ও দক্ষিণ মেরু নড়ে উঠবে আর এর ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ   মারা যাবে। যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে টিকিটিকির জিনসমৃদ্ধ নতুন একপ্রজাতির মানুষ ক্রীতদাস বানিয়ে রাখেবে। এই টিকটিকি মানবদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে বৃটিশ রাজ পরিবার ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হাতে]

•    এবছর আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে থাকা শক্তিশালী কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে একই রেখায় অবস্থান করবে পৃথিবী ও তার উপগ্রহ চাঁদ
•    নস্ট্রাডামাস এ বছর মহাপ্রলয়ের ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন
•    এবার সর্বোচ সৌর কলঙ্ক সৃষ্টির বছর। এসময় সূর্যের চৌম্বকীয় মেরুগুলো স্থানবদল করে। যার ফলে এর চৌম্বকীয় তরঙ্গ প্রভাব ফেলতে পারে সৌর পরিবারে।

মূল কথা মহাজাগতিক কিছু স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিক ঘটনা, কিছু অলীক বা ভিত্তিহীন ধারণা, কিছু ভবিষ্যৎবাণীর (যেগুলো সত্য হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই) ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, ইউটিউবে যে যার মত গল্প বানিয়ে গেছেন। এখনকার ইন্টারনেট-এসএমএস-এমএমএস নিয়ন্ত্রিত যুগে এসব গল্প ডালপালা গজিয়ে অবস্থা এমন করেছে যে, ২০১২-এর ২১ ডিসেম্বর আসলেও বুঝি কিছু একটা মহাপ্রলয় ঘটতে যাচ্ছে বলে কেউ কেউ একধরনের সুপ্ত ভয়ের জগতে আছেন। এরমধ্যে হলিউডে তৈরি ‘২০১২’ চলচ্চিত্রটির প্রচারণা এমনভাবে চালানো হয় যে, ২০১২ সালের ‘সম্ভাব্য ঘটনা’ সম্পর্কে তোলপাড় করা কোনো গূড়তত্ত্ব প্রকাশ করবে সিনেমাটি। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই ছিল না এতে। অপরদিকে, অসাধারন কিছু স্পেশাল ইফেক্টসমৃদ্ধ বিগ বাজেটের এই ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। আর মহাপ্রলয়, কেয়ামত বা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার ভিত্তিহীন দিন-তারিখ যুগে যুগে কল্পনাবিলাসী মানুষ অনেকবারই ঘোষণা করেছে যার কোনোটাই সত্য হয়নি। আর তাই এবারকারটিও সত্যি হবার কোনো কারণ নেই বলেই মনে করছেন মূল ধারার বিজ্ঞানী আর পণ্ডিতরা।

ভারতীয় জ্যোতির্বিদ দুরাই বলেন, পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাব্য ঘটনা নিয়ে অনেক গল্পই প্রচলিত আছে। এর একটি হল নিবুরু গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর কথিত-সম্ভাব্য সংঘর্ষের কথা।     কিন্তু এধরনের কোনো মহাজাগতিক বস্ত এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের নজরে আসেনি। জ্যোতির্বিদরা শক্তিশালী দূরবীণ ও অন্যান্য মাধ্যমে সার্বক্ষণিক খোঁজ-তল্লাশি করেও আশপাশের মহাকাশ বা নক্ষত্রমণ্ডলীতে এমন কোনো বস্তুর অস্তিত্ব পাননি যাকে ‘এক্স’ গ্রহ বা নেবুরু গ্রহ নামে চিহ্নিত করা যায় এবং যা পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ করতে ছুটে আসছে। 

সূর্য, পৃথিবী আর আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের এক সরল রেখায় অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকেই বলছেন এতে পৃথিবীর ভারসাম্যে বিচ্যুতি ঘটবে। কিন্তু পৃথিবী, সূর্য আর আকাশগঙ্গা প্রতি বছরই একবার এমন সরল রেখায় অবস্থান নেয়। কিন্তু এতে সূর্য বা পৃথিবীর কক্ষপথ বা গতির ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না।

তিনি ২১ ডিসেম্বর কোনো ধরনের সংঘর্ষের ফলে পৃথিবী ধ্বংস হওয়াটা অসম্ভব উল্লেখ করে বলেন, মায়া দিনপঞ্জী মোতাবেক ২০১২ সারের ২১ ডিসেম্বর দুনিয়ার শেষদিন বলা ‍হয়নি। তাদের ক্যালেন্ডার মোতাবেক ওই দিনটি তাদের একটি ক্যালেন্ডার যুগের (৫১২৫ বছর বা ১৩ বাখতুন) শেষ দিন। তাদের ১ বাখতুন প্রায় ৩৯৩ বছর দীর্ঘ।

দুরাই বলেন, মায়াদের ধারণা ছিল, ১৩টি বাখতুন (৫১২৫ বছর অর্থাৎ এক ক্যালেন্ডার যুগ) শেষ হওয়ার পর নতুন এক যুগের সূচনা হবে। এ সূত্রে বলা যায়, কিছু লোক যে বলছে ২১ ডিসেম্বর ২০১২ পৃথিবীর শেষদিন, তা তো মায়া সভ্যতার তত্ত্বও সমর্থন করছে না।
  
প্রসঙ্গত, আমাদের সাধারণ ক্যালেন্ডার ৩১ শে ডিসেম্বর শেষ হয়, আবার শুরু হয় ১ জানুয়ারি থেকে। এর ব্যাপ্তি আমাদের হিসাবে এক বছর। কিন্তু মায়ানদের ক্যালেন্ডার লম্বা গণনা সময় ধরে চলে। ফলে একটি চক্রের (৫১২৫ বছর বা ১৩ বাখতুন) শেষে তাদের আরেকটি লম্বা গণনা চক্র শুরু হবে।

মোট কথা ২১ ডিসেম্বর ২০১২ পৃথিবী বা মানব সভ্যতার শেষ হচ্ছে— এ ধারণার সত্যি কোনো ভিত্তি সত্যি।

No comments

Powered by Blogger.