রূপকথা ও বাস্তবে by ইবনে মাজেদ

ছোটবেলার গল্পগুলোর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা অন্য কারও বলা এসব গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকেন একজন রাজা। যেমন_ একদেশে এক রাজা ছিল, তার উজির-নাজির ছিল ইত্যাদি নানা গল্প সবাই শুনেছে। এখনও যারা শিশু তাদের অনেকের কাছেও হয়তো রাজা চরিত্রটা খুব প্রিয় কিংবা প্রতিনিয়তই তারা রাজাকে উপলক্ষ করে গল্প শোনে।


এ রাজা আসলে রূপকথার রাজা। এই রাজার সঙ্গে কি বাস্তবের কোনো রাজার মিল আছে? মানে একটা দেশ থাকবে, সেখানে দেশের প্রধান হবেন রাজা। উত্তরটা আমাদের দেশের সঙ্গে মেলালে শিশুদের কাছে ধাঁধাই মনে হবে। যে ধাঁধায় নিজেও পড়েছি। কারণ গল্পে রয়েছে রাজা, বাস্তবে দেশ শাসন করছে প্রধানমন্ত্রী। কিংবা আমরা কেবল প্রধানমন্ত্রী আর প্রেসিডেন্টের কথাই শুনি কিন্তু রাজার কথা শুনি না। মানে আদৌ কি কোনো দেশে রাজা আছেন? গল্পের রাজা কি সত্যিকার রূপকথারই রাজা? তাহলে এই রাজা এলো কোত্থেকে?
সেই ধাঁধার উত্তর হয়তো বড় হয়ে অনেকে পেয়েছেন যে, আসলে আগে রাজারাই রাজ্য শাসন করত। এখনও কোনো কোনো দেশে রাজা রয়েছে। এই কৌতূহল থেকে ঠিক কোন কোন দেশে রাজা দেশ পরিচালনা করেন তা জানতে গুগলে 'কান্ট্রিজ বাই সিস্টেম অব গভর্নমেন্ট' লিখে সার্চ দেওয়া যাক। গোটা দুনিয়ার একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে। উইকিপিডিয়া প্রত্যেকটি দেশের সরকার ব্যবস্থাকে একটি আর্টিক্যালের মধ্যে সুন্দরভাবে এনেছে। ১৯৭টি দেশের মধ্যে নিরেট রাষ্ট্রপতিশাসিত দেশ রয়েছে ৪২টি। এখানে কোনো প্রধানমন্ত্রী নেই। রাষ্ট্রপতি নিজেই রাষ্ট্র এবং সরকারের প্রধান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর অন্যতম। এরপর রয়েছে রাষ্ট্রপতিশাসিত দেশ, তবে সেখানে প্রধানমন্ত্রীও রয়েছেন। এ রকম দেশের সংখ্যা ২১টি। দক্ষিণ কোরিয়া এর অন্যতম। এরপর সেমি-রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী উভয়ই রয়েছেন। ক্ষমতা প্রধানত রাষ্ট্রপতির, তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীরও ক্ষমতা রয়েছে। এই সারিতে রয়েছে ২৭টি দেশ। তবে সবচেয়ে বেশি দেশে এখন রয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র। বাংলাদেশ এর অন্যতম। ৪৭টি দেশের শাসন ব্যবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্র। ৫টি দেশে রয়েছে মিক্স প্রজাতন্ত্র। কেবল সুইজারল্যান্ডে রয়েছে ডাইরেক্টরিয়াল সিস্টেম।
এরপরের শাসন পদ্ধতির কথা বললে হয়তো অনেকে বলবে, এই বুঝি সেই রাজা। উত্তরটা না। এই পদ্ধতির নাম হলো_ সাংবিধানিক রাজতন্ত্র (আনুষ্ঠানিক রাজা নিয়ে)। এখানে প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান, তবে রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাজা। এ রকম দেশের সংখ্যা ২৯। যুক্তরাজ্য এর অন্যতম। আরও ৯টি দেশে রয়েছে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। যেখানে প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন এবং রাজার রয়েছে সার্বভৌম ক্ষমতা। কুয়েত এর অন্যতম। গল্পের রাজা বলতে রাজাশাসিত যে দেশ সেটা রয়েছে ৬টি দেশে। উইকিপিডিয়ার ভাষায়, কান্ট্রিজ উইথ অ্যাবসলুট মনার্কিজ। ব্রুনাই, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সোয়াজিল্যান্ড এবং ভ্যাটিকান সিটি_ এই ছয়টি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা রাজার। রাজারা নিজেদের ইচ্ছামতো দেশ চালান।
তবে রূপকথার রাজাদের ক্ষমতা বুঝি আরও বেশি ছিল। তারা যা চাইত তা-ই করতে পারত। এক রাজার তো এ রকম কাহিনী ছিল, যে প্রতিরাতে একজন কুমারী মেয়েকে বিয়ে করত আর সকালে তাকে হত্যা করত।
আজকের দিনে আমাদের শাসন ব্যবস্থার কর্তারা এসব রাজার চেয়ে ব্যতিক্রম কি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষমতার কথা বলা হলেও তা নেই। জনগণের রায়ে শাসন ব্যবস্থার দায়িত্বে আসা সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত বলেন, 'আমরা ক্ষমতায় এসেছি', কখনোই বলেন না 'আমরা দায়িত্ব পেয়েছি'। এরা দেশের টাকা লুটপাট, দুর্নীতিসহ নিজেদের সুবিধার জন্য যা করার সবই করেন। রাজনৈতিক দলগুলোতে রাজাদের মতোই বংশপরম্পরায় দলীয় প্রধান আসছে। ফলে বর্তমান রাজা আর রূপকথার রাজা কি কেবলই নামের ধাঁধায় আবদ্ধ নয়?
 

No comments

Powered by Blogger.