খালেদার জনসভা কাল-বরিশালে ধারা পাল্টে সহযোগিতা করছে আ. লীগ by রফিকুল ইসলাম

২০০১ সালের নির্বাচনের পর বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র দেখতে এসে ওই বছরই বরিশাল সার্কিট হাউসে হামলার শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা।


এরই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে জাতীয় দিবসে স্থানীয় শহীদ মিনারে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ কর্মসূচিতেও নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল বিএনপির লোকজন। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা বরিশাল সফরে এলে গৌরনদীতে তাঁর গাড়িবহরেও হামলা চালানো হয়। জনসভামুখী নেতা-কর্মীদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। এমনকি শেখ হাসিনার সফরসঙ্গীদের বিরুদ্ধে উল্টো চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগও তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর কম-বেশি নির্যাতন চালিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বরিশাল আওয়ামী লীগ হানাহানির রাজনীতির ধারা থেকে সরে এসে বিরোধী দলের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বরিশাল সফরে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। গত শুক্রবার বিকেলে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। বরিশালে বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
খালেদা জিয়া আজ রবিবার দুপুরে বরিশালের উদ্দেশে রওনা দেবেন। আগামীকাল সোমবার বিকেল ৩টায় বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে (বেলস্ পার্ক মাঠ) জনসভায় তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। জনসভা শেষ করে রাতেই সড়ক পথে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন তিনি। এদিকে আজ ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে তিনি মানিকগঞ্জে বিএনপির সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের কবর জিয়ারত করবেন।
সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএনপি আমাদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল তা অমানবিক। আমরা তাদের নির্যাতনের পাল্টা জবা দেইনি। উল্টো তাদের নেত্রীর বরিশাল সফর সফল করার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে বিএনপি হানাহানির রাজনীতি থেকে সরে আসে।' সহযোগিতার নিদর্শন তুলে ধরে মেয়র বলেন, 'দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের নৈরাজ্যের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে শহরের সদর রোডে বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল। কিন্তু আমরা সেই সমাবেশ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে করেছি, যাতে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে।' তিনি আরো বলেন, 'যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কিছুদিন আগে ব্যানার টানানো হয়েছিল। নিজ দলীয় নেতা-কর্মীদের সেই ব্যানার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি, যাতে নগরীতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ব্যানার-ফেস্টুন লাগাতে পারে। তা ছাড়া বিরোধীদলীয় নেত্রী যে সড়কগুলো ধরে শহরে প্রবেশ করতে পারেন, সেগুলো সংস্কার করে দেওয়া হয়েছে।'
প্রশংসা করলেন সরোয়ার : এ ব্যাপারে মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সংবাদ সম্মেলন করে মেয়রের সহযোগিতা কামনা করেছিলাম। আমাদের চাওয়ার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে মেয়র নিজেই খালেদা জিয়ার সমাবেশস্থলের প্রস্তুতি দেখতে গেছেন। মেয়র সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বরিশালের রাজনীতিতে যে নজির স্থাপন করলেন তা অবিস্মরণীয়। আগামীতে আমরা সরকার গঠন করলে আমরাও সহাবস্তানের বিষয়টি প্রাধান্য দেব।'
ব্যানার-ফেস্টুনে ঢাকা : নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের সব পাড়া-মহল্লায় শোভা পাচ্ছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, দলীয় নেতা তারেক রহমান ও স্থানীয় বিএনপির নেতাদের ছবিসংবলিত ডিজিটাল ব্যানার-ফেস্টুন। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশের ফুটপাতেও লোহার পাইপ গেড়ে বহু বিলবোর্ড ও ফেস্টুন বসানো হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি রাস্তায় বিভিন্ন নেতা-কর্মীর প্রশংসাসূচক তোরণও তৈরি করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেত্রীর সমাবেশ সফল করার আহ্বান এবং তাঁকে স্বাগত জানিয়ে থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও নিজেদের ছবি লাগিয়ে ব্যানার টানিয়েছেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলা বিএনপির নেতারাও।
বিএনপির সভাপতি আহসান হাবিব কামাল বলেন, '১৯ নভেম্বরের মহাসমাবেশে নেত্রী খালেদা জিয়া ভাষণ দেবেন। অথচ সন্ত্রাসী ও পাতি নেতা-কর্মীরা কিছু ডিজিটাল ব্যানারের এক কোনায় নেত্রীর ছবি ছোট করে দিয়ে নিজের ছবি বড় করে প্রচার করছে। এরা জনসভার নয়, নিজেদের প্রচারে নেমেছে।'
বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি সৈয়দ দুলাল বলেন, 'নিজেকে অন্যের সামনে উপস্থাপন করার জন্য এ ধরনের ন্যক্কারজনক উপস্থাপনভঙ্গি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রুচির অভাবের পরিচয় বহন করছে।'
৯ সড়কে ৭৪ তোরণ : নগরীর প্রবেশদ্বার গড়িয়ার পাড় থেকে নথুল্লাবাদ পর্যন্ত ২২টি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। নথুল্লাবাদ থেকে বিএম কলেজ, হাসপাতাল রোড, জেলখানার মোড়, সদর রোড হয়ে সভাস্থল পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে ২৭টি তোরণ। এ ছাড়া নথুল্লাবাদ থেকে আমতলা মোড় হয়ে সভাস্থল পর্যন্ত বানানো হয়েছে ২৫টি তোরণ।
জানতে চাইলে মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, 'মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে ৩০ থেকে ৩৫টি ডিজিটাল ব্যানার লাগানো হয়েছে। এতে আনুমানিক দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।'
ব্যয় কোটি টাকা : জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হাফিজ আহম্মেদ বাবলু জানান, প্রায় ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে ৪০ ফুট দীর্ঘ এবং ২৫ ফুট চওড়া তিনটি ব্যানার বানিয়েছেন তিনি। শহরের বিবির পুকুর পাড়, সার্কিট হাউস এবং সমাবেশস্থলের পশ্চিম পাশে সেগুলো লাগানো হয়েছে।
নগরীর মিডিয়া জোনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জানান, প্রতি বর্গফুট ডিজিটাল ব্যানার করতে ব্যয় হয় ২৫ টাকা। সেই হিসাবে একটি ব্যানারে খরচ হয় ৯০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি ফেস্টুনে খরচ হয় ৪০০-৫০০ টাকা। ১৬ নভেম্বর থেকে ডিজিটাল ব্যানার তৈরির অর্ডার নেওয়া বন্ধ রয়েছে। বরিশালে হাজার হাজার ব্যানার-ফেস্টুন ঢাকা থেকে করিয়ে আনা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যানার-ফেস্টুন আর তোরণ মিলিয়ে ব্যয় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.