টাঙ্গাইল-৩ উপনির্বাচন-নৌকা, আনারস, লাঙ্গল দিনশেষে জয়ধ্বনি কার

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে উপনির্বাচন আজ রবিবার। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে দলের একজন বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নির্বাচনী উত্তাপ অন্য রকম এক মাত্রা পেয়েছে। তাঁদের পাশাপাশি লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে লড়ছেন জাতীয় পার্টির একজন প্রার্থী। ফলে ভোটারদের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ।


শেষ সময় প্রার্থীদের সমর্থকরাও ভোটার টানতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আজ দিনশেষেই পরিষ্কার হয়ে যাবে নৌকা, আনারস, লাঙ্গল- এই তিন প্রতীকের কোনটি বিজয় ছিনিয়ে আনে।
আওয়ামী লীগের এমপি ডা. মতিউর রহমান মারা যাওয়ায় আসনটি শূন্য হয়।
গত শুক্রবার এক নির্বাচনী জনসভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম দলের বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানাকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন। তবে রানার কর্মী-সমর্থকরা দাবি করছেন, বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। দুই প্রার্থী পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগও এনেছেন।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানা গতকাল অভিযোগ করেন, শুক্রবার রাতে তাঁর চার কর্মীকে মারধর করে তাদের অর্থ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে নারী ভোটারদের মধ্যে ছড়ানো হয় আতঙ্ক। নৌকা প্রতীকে ভোট দিলে ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়।
এদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. শহিদুল ইসলাম লেবু বেশ কিছু কেন্দ্রে সহিংসতা ঘটবে বলে আশঙ্কা করেছেন। লেবুর নির্বাচন সমন্বয়কারী শহীদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, গতকাল রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়া এক আবেদনপত্রে প্রার্থী লেবু বলেছেন, বিভিন্ন ইউনিয়নের মোট ২৩টি ভোটকেন্দ্র রানার সমর্থকরা দখল করে নিতে পারে।
গতকাল শনিবার উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচন নিয়ে একধরনের উৎসবের আমেজ। কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন মালামাল নেওয়া হচ্ছে। ভোটাররা যাতে সারিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোট দিতে পারে সে জন্য কেন্দ্রগুলোর সামনে বাঁশ ও রশি বেঁধে রাখা হয়েছে। ৪৫ জন মেজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমাণ আদালত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া র‌্যাব, পুলিশ, আনসার, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরাও উপজেলাজুড়ে কড়া নজরদারি করছেন।
'ঘরোয়া বৈঠক' : শুক্রবার মধ্যরাত থেকেই নির্বাচনী প্রচার অর্থাৎ সভা-সমাবেশ বন্ধ রয়েছে। এ হিসেবে গতকাল কোনো সভা-সমাবেশ না হলেও থেমে ছিলেন না প্রার্থীরা। জানা যায়, গতকাল পৌরসভার শান্তিনগর এলাকায় একটি পূজাপণ্ডপে গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শহিদুল ইসলাম লেবু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় শ-তিনেক লোকের উপস্থিতি ছিল বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লেবুর নির্বাচন সমন্বয়কারী শহীদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘাটাইল সদরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে 'সভা' করেছেন। নির্বাচনের আগের দিন যেকোনো ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ। এর পরও কিভাবে 'বৈঠক' করা হলো জানতে চাইলে শহীদুজ্জামান বলেন, 'সভা নয়, আমরা উঠোন বৈঠক করেছি।' উঠোন বৈঠকও করা যায় না- বলা হলে এবার তাঁর মন্তব্য, 'আমরা ঘরোয়া বৈঠক করেছি।'
এদিকে বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানা বাসায় থেকেই ভোটারদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। গণসংযোগে ব্যস্ত ছিলেন জাতীয় পার্টি মনোনিত প্রার্থী সৈয়দ আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ তুহিনও। শুক্রবার জনসভায় আমানুর রহমান খান রানাকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়ায় লেবুর সমর্থকরা উচ্ছসিত হলেও এতে মাঠের ভোটের হিসাবে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে জানিয়েছে রানার সমর্থকরা।
তবে ভোটারদের বিশ্লেষণ অন্যরকম। রানা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য, ঘাটাইলে রানার বিরুদ্ধে তেমন কোনো দুর্নাম নেই। আর লেবুর বিরুদ্ধে টিআর, কাবিখার চাল-গম আত্মসাৎ এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অভিযোগ রয়েছে। ভোটারদের কেউ কেউ বলছে, রানাকে যারা ভোট দেবে, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশই লেবু বিদ্বেষী। এদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী তুহিনের বেশ সুনাম রয়েছে ঘাটাইলে। এই শিল্পপতির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ না থাকলেও দলের বড় ধরনের ভোট ব্যাংক না থাকায় কিছুটা বেকায়দায় পড়তে পারেন তিনি।
ঘাটাইলের রাজনৈতিক সচেতন কয়েকজন ভোটার কালের কণ্ঠকে বলেছেন, উপজেলার সন্ধানপুর, ধলাপাড়া ও রসুলপুর ইউনিয়নে মোট ভোট রয়েছে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার। এই তিনটি ইউনিয়নে রানার অবস্থান ভালো। এ ছাড়া রানার নিজের এলাকা ডিঘর ইউনিয়ন ও আনাহলা ইউনিয়নেও তিনি জনপ্রিয়। লেবু এগিয়ে থাকবেন ঘাটাইল পৌর এলাকার ভোটে। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ ভোট লেবু পেতে পারেন- এমন গতানুগতিক ধারণাও অনেকে পোষণ করেন।
এদিকে শুক্রবারের জনসভায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম আমানুর রহমান খান রানাকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিলেও নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছে তাঁর সমর্থকরা। রানার একান্ত ব্যক্তিগত সচিব মির্জা রানা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর আমানুর রহমান খান রানা দলীয় মনোনয়ন না পেলেও দলের কোনো সমালোচনা করেননি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আমাদের সমর্থকদের বেশির ভাগেরই ধারণা ছিল, দল থেকে তিনি বহিষ্কৃত হতে পারেন। শেষ মুহূর্তে হয়েছে তাই-ই। তাই এতে আমাদের কর্মী-সমর্থকদের কেউই হতাশ নন।'
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ : গতকাল শনিবার রিটার্নিং অফিসারের কাছে চারটি অভিযোগ করেছেন আমানুর রহমান খান রানা। এতে বলা হয়, শুক্রবার রাতে উপজেলার কান্দুলিয়াপাড়ার সোহেল ভূঁইয়া, বেলদহ গ্রামের ইকবাল হোসেন খান, আনেহোলার মো. শাজাহান আলী তালুকদার ও পাঁচটিকড়ির মো. ইদ্রিস মিয়া নিজ নিজ এলাকায় আনারস মার্কার নির্বাচনী প্রচার চালান। এ সময় লেবুর সমর্থকরা সন্ত্রাসী বাহিনীর সহায়তায় তাঁদের মারধর করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এ ছাড়া লেবুর সমর্থকরা নারীদের হুমকি দেয় যে, আনারস মার্কায় ভোট দিলে তাদের ক্ষতি করা হবে, সেই সঙ্গে ঘরবাড়িতে দেওয়া হবে আগুন। একই সঙ্গে দিঘর ইউনিয়নের মেম্বার মুজিবুরকেও মারধর করার অভিযোগের কথা জানিয়েছেন রানার একান্ত সচিব (পিএস) মির্জা রানা। এ ছাড়া প্রশাসন সরকার সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে কারচুপি করতে পারে বলেও আশঙ্কা করেছেন তিনি।
এদিকে লেবুর নির্বাচন সমন্বয়কারী শহীদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, গতকাল রিটার্নিং অফিসারের কাছে করা আবেদনে তাঁদের প্রার্থী আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে, বিভিন্ন ইউনিয়নের ২৩টি ভোটকেন্দ্র রানার সমর্থকরা দখল করে নিতে পারে। এসব কেন্দ্রের মধ্যে রানার জন্মস্থান দিঘর ইউনিয়নের ৯টি কেন্দ্র রয়েছে।
প্রস্তুত প্রশাসন : রিটার্নিং অফিসার সৈয়দ খোরশেদ আনোয়ারের পক্ষে তাঁর স্টাফ অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, আজ রবিবার উপজেলার ৯৬টি ভোটকেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিরতিহীনভাবে চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। মোট ৫৮২টি ভোটকক্ষে দুই লাখ ৭১ হাজার ৩২৯ জন ভোটার তাদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করবেন আজ। ইতিমধ্যে নির্বাচনী উপকরণ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। ভোটদানের সুবিধার্থে উপজেলার সব সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে প্রশাসন।
টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ সুপার এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনের সব প্রস্তুতিই নেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচনী মাঠে 'জিরো টলারেন্স' অবস্থায় থাকবে। নির্বাচনী মাঠে পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, বিজিবি, আর্মড পুলিশসহ প্রায় চার হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। সবচেয়ে ছোট ও শান্তিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে কমপক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৭ জন করে সদস্য মোতায়েন থাকবে। বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে এ সংখ্যা আরো বাড়বে। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক সদস্য উপজেলার বিভিন্ন রাস্তায় ও ভোটকেন্দ্রের চারপাশে টহল দেবে। কোথাও গোলযোগের আশঙ্কা দেখা দিলেই সেখানে গিয়ে হাজির হবে তারা।

No comments

Powered by Blogger.