সমকালীন প্রসঙ্গ-শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি by বদরুদ্দীন উমর

শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির অনেক দিক আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে দুর্নীতি। স্কুলের কথাই প্রথমে বলা দরকার। বাংলাদেশে চুরি-দুর্নীতি যেমন দ্রুত ও ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে, তেমনি তার উল্টোদিকে শিক্ষার বিস্তারও হয়েছে দ্রুত ও ব্যাপকভাবে।


বিস্তার হওয়ার অর্থ হলো আজকের দিনে মানুষ শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে এত সচেতন হয়েছে যে, শুধু উচ্চ বা মধ্যবিত্ত নয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যেও নিজের সন্তানকে সাধ্যমতো শিক্ষা দেওয়ার একটা চেষ্টা এখন সাধারণভাবে দেখা যায়। এ জন্য অনেক শ্রমজীবী পরিবার নিজেদের খাওয়া-পরার কষ্ট স্বীকার করেও সন্তানদের লেখাপড়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কলকারখানার শ্রমিক, রিকশা-ভ্যান শ্রমিক, হকার, এমনকি বাসাবাড়িতে কাজ করা মহিলারা পর্যন্ত অনেকে এখন নিজেদের সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সাধ্যের বাইরে খরচ করেন। গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতেও ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। এ স্কুলগুলোকে ছাত্রদের মাঝপথে ঝরে পড়ার ব্যাপার সাধারণ হলেও তার মূল কারণ, তাদের অভিভাবকদের শিক্ষা-বিরোধিতা নয়। দারিদ্র্যই এর কারণ। গ্রামের গরিবের সন্তানদের অনেককেই কাজ করতে হয় সংসারে খরচের কিছু জোগান দেওয়ার জন্য। নিজেদের খাওয়ার জন্যও। এ জন্য দেখা যায় যে, যেসব স্কুলে দুপুরে খাওয়ার একটা ব্যবস্থা থাকে সেখানে মাঝপথে ঝরে পড়া ছাত্রের সংখ্যা কম হয়।
শহর ও গ্রামাঞ্চলে গরিবদের সন্তানরা যেসব স্কুলে কোনো রকমে লেখাপড়ার সুযোগ পায় সেগুলোর মান শোচনীয়। কোনো ভালো শিক্ষক তো থাকেই না, এমনকি এই শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাসও করেন না। এর জন্য যে শুধু শিক্ষকরাই দায়ী তা নয়। তারাও গরিব এবং স্কুলের বেতনে তাদের সংসার না চলায় তাদের অতিরিক্ত অন্য কাজ করতে হয়। তাছাড়া এসব বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন পান না। অনেকে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর পর্যন্ত বেতন নয়। সরকারের কাছে এ নিয়ে দেনদরবার অথবা আন্দোলন করেও এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় না। এ জন্য দেখা যায় বোর্ডের পরীক্ষায় অনেক গরিব স্কুলের সব ছাত্রই ফেল করে। ফেল করার কারণ ছাত্রদের কম বুদ্ধি ও আগ্রহের অভাব নয়। এর কারণ সুযোগ-সুবিধার প্রচণ্ড অভাব। কাজেই বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে সন্তানদের শিক্ষার চিন্তা ও তাগিদ বৃদ্ধি এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষার বিস্তার ঘটলেও এ শিক্ষার মান খুব নিচু।
এ তো গেল একেবারে গরিবদের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার কথা। অর্থনৈতিক বিচারে তাদের থেকে উন্নত অবস্থায় থাকা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মধ্যেও শিক্ষা সংকট যথেষ্ট প্রবল। তারা তুলনামূলকভাবে ভালো স্কুলে পড়লেও এগুলোর মানও সন্তোষজনক নয়। বেসরকারি স্কুলে দেশের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে। দেশের ১৮ হাজার এসব স্কুলে ছাত্রসংখ্যা হলো ৭৫ লাখ। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক এই স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কম। তবে বেসরকারি স্কুলের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কিছু শহরে কিছু ভালো বেসরকারি স্কুল আছে। এগুলোতে উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষকরা পাঠদান করেন এবং নিজস্ব বইপত্র, লাইব্রেরিসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা এই ছাত্রদের অনেক বেশি। এই স্কুলগুলোর পরীক্ষার ফলাফলও হয় সব থেকে ভালো। সব ছাত্রই পরীক্ষায় পাস করে এবং অনেকে খুব ভালো ফল করে। পরীক্ষার ফলাফলের হিসাবে দেখা যায় যে, ঢাকার কয়েকটি স্কুলের মধ্যেই এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হয়। অন্যান্য শহরের এ ধরনের স্কুলেও হয় একই ব্যাপার। এই স্কুলগুলোতে সাধারণত উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরাই লেখাপড়া করে। এগুলোতে ভর্তি হওয়া ছাত্র এবং অভিভাবকদের জন্য এক মস্ত সমস্যা।
এই সমস্যার কারণে অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকা অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের ভালো বেসরকারি স্কুলে ভর্তির জন্য যে কষ্ট স্বীকার করেন, সেটা লক্ষ্য করার মতো। কিন্তু তাদের এই কষ্ট সত্ত্বেও অনেকে সন্তানদের ভর্তি করতে পারেন না। শুধু ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে যদি এটা হতো, তাহলে এ নিয়ে বলার কিছু থাকত না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল থেকে দুর্নীতির ভূমিকাই থাকে অনেক বেশি। বাংলাদেশে সবসময়েই এটা দেখা যায়। এ নিয়ে কয়েক বছর আগে ঢাকার ভিকারুন নিসা স্কুলে যে কেলেঙ্কারি হয়েছিল সেটা এর সব থেকে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতি। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বেসরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তির জন্য নতুন করে কোটা নির্ধারণের ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে সংসদ সদস্যদের জন্য বেসরকারি স্কুলগুলোতে শতকরা দু'ভাগ ছাত্র ভর্তির কোটা নির্দিষ্ট করার। ১১ নভেম্বর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে আলোচনা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা বোর্ডের অফিসারদের এবং অনাবাসী বাংলাদেশিদের জন্য শতকরা এক ভাগ ভর্তি কোটা বৃদ্ধির। আগেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাদের সন্তানদের জন্য শতকরা পাঁচ ভাগ কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ ছাড়া শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের সন্তানদের জন্য দেওয়া হয়েছে শতকরা এক ভাগ। প্রত্যেক বছরই সরকারি ক্ষমতায় থাকা লোকজন ও সরকারি অফিসারদের ভর্তি নিয়ে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে; কিন্তু এ নিয়ে কিছুই হয় না। এখন এই দুর্নীতিকে সরকারি স্বীকৃতি দিয়ে উপরোক্ত ব্যক্তিদের জন্য কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে (ডেইলি স্টার, ১২.১১.২০১২)।
কোটা ছাড়াই বেসরকারি স্কুলগুলোকে উপরোক্ত ব্যক্তিরা যেভাবে ভর্তির সময় দুর্নীতি করে থাকেন, তার কথা দেশসুদ্ধ লোক জানে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোটা নির্ধারণ করে দেওয়ায় এই দুর্নীতি আরও অনেক ভালো ও সাংবিধানিকভাবে করার সুযোগ তৈরি হলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই কাজ সরকারিভাবে দুর্নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া আর কি? কিন্তু শুধু সংসদ সদস্য বা সরকারি কর্মচারীরাই নয়, খোদ স্কুলগুলোর পরিচালনা কমিটিগুলোও বেশ বেপরোয়াভাবে এই দুর্নীতি করছে। সাধারণভাবে এসবই এখন ভর্তিবাণিজ্য নামে পরিণত হয়েছে। এই বাণিজ্য করে কতগুলো স্কুল ছাত্রদের থেকে ভর্তি বাবদ অনেক অতিরিক্ত আদায় করছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ডের বিগত ৪ জুলাইয়ের একটি তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকার আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বাড়তি আদায় করেছে প্রথম শ্রেণীর ৩ হাজার ৪৯ জন ছাত্রের থেকে। মনিপুর হাইস্কুল এভাবে ৩ হাজার ৫৪ ছাত্র থেকে আদায় করেছে ৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ভিকারুন নিসা স্কুল এক হাজার ৬২৭ জন প্রথম শ্রেণীর ছাত্রের থেকে আদায় করেছে ৬৮.১৭ লাখ টাকা। (ঐ) সরকার এই অতিরিক্ত টাকা ছাত্র অভিভাবকদের ফেরত দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু এটা যে শেষ পর্যন্ত কথার কথায় দাঁড়াবে এতে সন্দেহ নেই।
স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে নিয়ে সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মচারী এবং বিভিন্ন ধরনের প্রভাবশালী লোকেরা এভাবে যে ভর্তিবাণিজ্য করছেন বা তাদের জন্য নতুন করে যে সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তাতে ভর্তিবাণিজ্যের অবস্থা সরকারি তত্ত্বাবধানে আগের থেকে অনেক বেশি রমরমা হওয়ার কথা।
বেসরকারি স্কুলগুলোতে এভাবে ভর্তিবাণিজ্যের যে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা হয়েছে তাতে দুটি বিষয় খুব স্পষ্ট। প্রথমত, টাকাপয়সার খেলোয়াড়রাই ভর্তির ব্যাপারে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে এবং এই খেলার মাধ্যমে সংসদ সদস্য থেকে নিয়ে সরকারি অফিসাররা তাদের পকেটভর্তি করবে। দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি হবে তা হলো, আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল ভালো ছাত্ররা ভর্তির সুযোগ না পেয়ে এমন স্কুলে পড়তে বাধ্য হবে, যেখানে তাদের লেখাপড়া উচিত মতো হবে না। ভর্তিবাণিজ্যের এটাই প্রকৃত ক্ষতিকর দিক। বাংলাদেশের সর্বত্র দুর্নীতি আজ এমনভাবে তার থাবা বিস্তার করে আছে, যাতে তা এখন সরকারিভাবেই স্বীকৃত। দুর্নীতিরই রাজত্ব আজ বাংলাদেশে। এর থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের জনগণ আজ কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে। পরিস্থিতির এই দিকটি ভয়ঙ্করভাবে বিপজ্জনক এ কারণে যে, এর থেকে উদ্ধার লাভের কোনো আশু সম্ভাবনা এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
১২.১১.২০১২

বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.