চরাচর-শহীদ তিতুমীর by জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

ছোটবেলায় ছেলেটির কঠিন রোগ হয়। তার দাদি বিভিন্ন গাছের বাকল বেটে তৈরি করেন তেতো এক ওষুধ। হাসিমুখে শিশুটি সেই ওষুধ সেবন করে সুস্থ হয়ে যায়। মজা করে তাই তাকে ডাকা হয় তেতো। আর যেহেতু সৈয়দ বংশের ছেলে, তাই তেতোর শেষে যোগ হয় মীর। হয়ে গেল তেতোমীর। আর এই তেতোমীরই বাংলার বীরত্বের প্রতীক তিতুমীর। প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী নামটি ঢাকা পড়ে আছে তিতুমীর নামের আড়ালে।


জন্ম ১৭৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের চবি্বশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে। বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া এই শিশুটি ছেলেবেলা থেকেই বেশ বলিষ্ঠ ও সুন্দর ছিল। জানা যায়, তিতুমীরের পূর্ববংশীয়রা হলেন হজরত আলী (রা.)-এর বংশধর। শিক্ষা বলতে তখন প্রধানত ধর্মীয় শিক্ষাটারই প্রাধান্য ছিল। তিতুমীর তখন এক মাদ্রাসায় হাফেজ নেয়ামত উল্লাহর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআন মুখস্থ করে হাফেজ হন। পাশাপাশি মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা, তীর ছোড়া, তলোয়ার চালানো ইত্যাদিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
১৮২২ সালে ৪০ বছর বয়সে তিনি হজ পালন করতে মক্কা শরিফ যান। সেখানেই পরিচয় হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হজরত শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সঙ্গে। তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিতুমীর দেশে এসেই তাঁর কী করণীয় তা ঠিক করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে অত্যাচারিত জনগণকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করেন। জমিদারসহ নীলকররা এতে রুষ্ট হয়ে তাঁকে গ্রামছাড়া করেন। তিতুমীর আশ্রয় নেন বারাসাতের নারকেলবাড়িয়ায়। নারকেলবাড়িয়ার লোকজন তিতুমীরকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে একজোট করে তিনি ভারতের স্বাধীনতার বীজ বুনতে মাঠে নামেন। ১৮৩১ সালে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন দুর্ভেদ্য বাঁশের কেল্লা। বাঁশ আর কাদামাটির গাঁথুনির কয়েক স্তর দিয়ে তৈরি করা হয় এই কেল্লা। এই কেল্লার ভেতর তিনি প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন সহযোদ্ধাদের। সেই সময় মোল্লাহাটির নীলকুঠির ম্যানেজার ছিল নীলকর ডেভিস। ডেভিস ও অন্য জমিদাররা মিলে তিতুমীরের ওপর আক্রমণ করে বসে। কিন্তু এই আক্রমণে হেরে গিয়ে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদারের কাছে আশ্রয় নেয়। এই জমিদারও তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল এবং নিহত হলো। এই খবর চাউর হয়ে গেল দ্রুত। ইংরেজ সরকার তখন আলেকজান্ডার নামের এক ব্রিটিশ সৈনিকের নেতৃত্বে আবারও আক্রমণ চালাল তিতুতীরের ওপর। আলেকজান্ডারও পরাজিত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। ইংরেজ বাহিনী পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ১০০ অশ্বারোহী, ৩০০ পদাতিক এবং দুটি কামান নিয়ে তিতুমীরের বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। তিতুমীরের বাহিনী তাদের সেকেলে অস্ত্র নিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সামনে এবার দাঁড়াতেই পারল না। পিছু হটে আশ্রয় নিল বাঁশের কেল্লায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কামানের গোলায় বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেল। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর তিতুমীর তাঁর বিপুলসংখ্যক স্বাধীনতা যোদ্ধাসহ শাহাদাৎবরণ করেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

No comments

Powered by Blogger.