পদ্মা সেতু প্রকল্প-আশা নিয়েও বিকল্প ভাবনায় সরকার

ওয়াশিংটন সফররত প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টার সঙ্গে বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের আলোচনা থেকে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ব্যাপারে ইতিবাচক ফল আশা করছেন সরকারের ঘনিষ্ঠজনরা। তবে বিশ্বব্যাংকের পদ্ধতিগত দীর্ঘসূত্রতা কাটিয়ে উঠে বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে সেই অর্থ ছাড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই তাঁরা মনে করেন।


অথচ পদ্মা সেতু কেবল সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারই নয়, এটি এখন মর্যাদারও প্রশ্ন। সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও মত, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনে জনগণের মুখোমুখি হওয়া সরকারি দলের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই নিজেদের অর্থায়নে অন্তত শুরুটা যাতে করা যায়, সেই ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন নীতিনির্ধারক বলেন, 'আমার বিশ্বাস, ওরা (বিশ্বব্যাংক) এবার সিদ্ধান্ত (ঋণচুক্তি বাতিলের) পুনর্বিবেচনা করতে রাজি হবে। যেসব শর্ত আমরা ইতিমধ্যে মেনে নিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়নের দৃশ্যমান উদ্যোগ তারা দেখতে চাইবে। আগামী ১২ থেকে ১৪ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বোর্ড অব গভর্নরসের বার্ষিক সভা হবে টোকিওতে। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ব্যাপারে তাদের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়তো তারা সেই বৈঠকেই আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে।'
তবে কেবল দুর্নীতির ধারণার ওপর ভিত্তি করে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের আচরণে সরকার যে নাজুক অবস্থায় পড়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও দাবি করবে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হবে, কোনো অর্থ ছাড় হয়নি। তাই এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কোনো দুর্নীতির সুযোগ নেই। তবে এটি দেশের ও বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ভবিষ্যতে এখানে যাতে কোনো দুর্নীতি না হয় সে জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে কিছু শর্ত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা সরকার মেনে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে যে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন, সরকার সেভাবে কাজ এগিয়ে নিতে পারে। পদ্মা সেতুর কোনো প্রান্তেই রেল সংযোগ নেই। বরিশাল, মাদারীপুর এলাকায় রেল যোগাযোগ স্থাপন করতে আরো দেড় শ কোটি ডলার লাগবে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলনেই বলা হয়েছে। তাই আলাদা রেল সেতু নির্মাণের বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য রেখে কেবল সড়ক সেতুর কথাই সরকার এখন ভাবছে। এক খসড়া হিসাব উল্লেখ করে ওই নীতিনির্ধারক বলেন, রেল বাদ দিলে পদ্মা সেতুর ব্যয় ১৮০ কোটি ডলারে নেমে আসবে। মূল প্রকল্পেই সরকারের বরাদ্দ রয়েছে ৬৫ কোটি ডলার। আর অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলে রয়েছে সাড়ে ২২ কোটি ডলার। বাস্তবায়ন সক্ষমতা কম থাকায় বৈদেশিক সহায়তার পরিপূর্ণ ব্যবহার হয় না। ফলে প্রতিশ্রুত অথচ ছাড় হয়নি, ১০ বছরে এ রকম বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ১৪০০ কোটি ডলার। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হলে বাড়তি বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। আর যদি ৫০ কোটি ডলারের ঘাটতি পড়ে, সরকারের পক্ষে তা জোগাড় করা কঠিন হবে বলে মনে করেন না ওই কর্মকর্তা।
পর পর তিন দিন অফিসে যাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। গত সোমবার পরোক্ষ সরকারি সূত্র থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, ড. মসিউর এক মাসের ছুটিতে গেছেন। পরের দিন তিনি জানান, তিনি ছুটির দরখাস্ত করেননি, বিতর্ক এড়ানোর জন্য সরকারি বৈঠকগুলোতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও ইআরডির সূত্রগুলো জোর দিয়ে বলছে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত ড. মসিউরের ছুটির প্রমাণপত্র নিয়েই পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ওয়াশিংটন গেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছুটিতে গেলে সাধারণত কোনো স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হয় না। কিন্তু ড. মসিউরের ছুটির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংককে দেখানোর জন্যই প্রমাণপত্র নিতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খানও ওয়াশিংটনে রয়েছেন এখন। সেখানে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের 'সর্বশেষ শর্ত' পূরণের প্রমাণপত্র উপস্থাপন করা হবে।
এ বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের ইতিবাচক মনোভাব পাওয়া যাবে বলে জোর আশাবাদ ব্যক্ত করছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের ওই নীতিনির্ধারক। তবে আজ থেকেও যদি প্রক্রিয়া শুরু হয়, বিশ্বব্যাংকের স্বাভাবিক গতিতে তা শেষ করে অর্থ ছাড়ের পর্যায়ে পেঁৗছাতে অন্তত ১০ মাস সময় লেগে যাবে। তত দিনে বর্তমান সরকারের কার্যকর মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় এক অর্থনীতিবিদ ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, দেরির কারণে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় পুনর্মূল্যায়নের প্রশ্নও এসে যায়। তাহলে আরো বেশি সময় লাগবে।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী বলেছেন পদ্মা সেতু হবে। যোগাযোগমন্ত্রীও বলেছেন এ অর্থবছরেই কাজ শুরু হবে। আমিও তা-ই চাই। আশা করি, বিশ্বব্যাংক তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। তবে সরকারের এ মেয়াদে সেতুর মূল কাজ শুরু করতে হলে নিজেদের অর্থেই এগিয়ে যেতে হবে।'
অবশ্য বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে রাজি হলে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে খুব বেশি দেরি হবে না বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করতে প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা ইতিমধ্যে ওয়াশিংটন গেছেন। সংস্থাটির সঙ্গে সমঝোতা হয়ে গেলে বাকি কাজ খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্পে সংস্থাটির সঙ্গে পুনরায় ঋণচুক্তি সই করতে হবে না। শুধু বিশ্বব্যাংক বোর্ডের অনুমোদন লাগবে। মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার সপ্তাহের এ দুই দিন বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভা বৈঠকে বসে। বৈঠকের ছোট একটি পেপার তৈরি করার প্রয়োজন হবে। কী বিবেচনায় এ প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল হয়েছে এবং কিসের বিবেচনায় তা পুনর্বিবেচিত হচ্ছে, তা উল্লেখ থাকবে। এরপর সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.