মানবাধিকার-এ কী বললেন অং সান সু চি! by নাসির আহমেদ

মিয়ানমারের বিরোধী দলের নেত্রী নোবেলজয়ী অং সান সু চি তার দেশের অধিকারবঞ্চিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে চমকে দেওয়ার মতো মন্তব্য করেছেন। তিনি সামরিক জান্তার স্বরেই যেন প্রত্যাখ্যান করলেন রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়। সু চি তো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক জননেত্রী শুধু নন, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে আপসহীন এক নন্দিত নাম।


মাত্র ২১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে যাকে ১৫ বছরই কাটাতে হয়েছে সামরিক জান্তার কারাগারে, তাকে তুলনা করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত জননেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে। জাতিগত বৈষম্যের তথা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ম্যান্ডেলা কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন ২৭ বছর। মিয়ানমারের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী বীর জেনারেল অং সানের কন্যা সু চি নিজ দেশের গণতন্ত্র হন্তারক সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন করে সারা পৃথিবীতে শান্তিবাদী মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির অনুসারী হিসেবেও পরিচিত। নোবেল শান্তি পুরস্কারও অর্জন করেছেন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবেই। নেলসন ম্যান্ডেলাও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছেন। বিজয়ী হয়েও প্রতিশোধ নেননি শ্বেতাঙ্গদের ওপর। বরং সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত গড়েছেন। শান্তির জন্য অর্জন করেছেন নোবেল পুরস্কার। ম্যান্ডেলা এ লেখার বিষয় নয়, শুধু নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমারের সংগ্রামী জননেত্রী অং সান সু চির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উচ্চতা বোঝানোর জন্যই ম্যান্ডেলার সঙ্গে এই তুলনা। সু চির মতো অক্সফোর্ডের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু নেত্রী যখন তার দেশের নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে নিষ্ঠুর মনোভাব প্রকাশ করেন, তখন বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। সেই বিস্ময় জাগানো উক্তিই করলেন তিনি গত সপ্তাহে ভারত সফরকালে। ভারতীয় সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে। আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ এবং তাদের ফিরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে সু চি যা বলেছেন, তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, বাংলাদেশই সে দেশে বাঙালি অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে।
মিয়ানমারের বিরোধীদলীয় নেত্রী তার দেশের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে গত জুন মাসে ঘটে যাওয়া নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে বলেছেন, 'আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা (ট্র্যাজেডি)'। বলেছেন মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসী প্রেরণ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত রিপোর্ট থেকে জানা গেল, রোহিঙ্গাদের তিনি মিয়ানমারের নাগরিকও মনে করেন না। এ বক্তব্যের প্রমাণ মেলে ভারতের এনডিটিভিকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি বলেছেন, 'রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তিনি এতদিন বেশি কিছু বলতে রাজি হননি। কারণ, তিনি দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে কাজ করতে চেয়েছেন।
আমরা জানি না, অং সান সু চির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, ইতিহাস-সচেতন ব্যক্তিত্ব কেমন করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মতো একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে রোহিঙ্গাদের 'রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী' বলে অভিহিত করলেন! অবিশ্বাস্য হলেও এ বক্তব্য তারই। আরও বিস্ময়কর যে, তিনি বলেছেন, সহিংসতার জন্য দু'পক্ষই দায়ী। তাই আমি কোনো পক্ষকে সমর্থন না করে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে চাই। পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অভিবাসীরা যত্রতত্র মিয়ানমারে প্রবেশ করছে। এই যাতায়াত বন্ধ না হলে সমস্যার সমাধান হবে না। মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক স্বার্থ বজায় রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা উচিত।
জানি না, অং সান সু চির এই অবাস্তব বক্তব্যের ব্যাপারে বাংলাদেশ কী ব্যাখ্যা দেবে অথবা দিয়েছে। বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে, এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা এবং বিশ্বসমাজের কাছে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা। জানানো উচিত রোহিঙ্গাদের নৃতাত্তি্বক এবং বংশপরম্পরা সে দেশের অস্তিত্বের কথাও। কারণ জরুরি ভিত্তিতে যদি অং সান সু চির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা না হয়, তাহলে তার মতো একজন নোবেলজয়ী নেত্রীর বক্তব্য অনেকেরই বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়ে যেতে পারে। আর একদিন পরে ১৯ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমার সফর করছেন। এই সফরের আগে বিরোধী দলের নেত্রী সু চির রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গে এমন অবাস্তব উক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হবে। আমরা জানি না, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সফরের আগে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিয়েছে কি-না। জাতিসংঘে শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা এবং এর কর্তাব্যক্তিরা যে অনেক দিন ধরেই রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অনুকূলে কাজ করছেন, তা আমাদের জানা। এমনকি তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এক ধরনের চাপই প্রয়োগ করছেন। এমনকি মার্কিন প্রশাসনও এ ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারকে কিছুই বলছে না!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে এই বার্তা পেঁৗছে দেওয়ার প্রয়োজন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের প্রয়োজনেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুসম্পর্ক গড়তে আগ্রহী, তা আমরা জানি। মিয়ানমার যেমন তার কাছে আজ গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী ব-দ্বীপ বাংলাদেশও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওবামা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারকে তিনি চাপ দেবেন। কিন্তু আমরা আশা করতে চাই_ তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিক থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং নিজ দেশেই স্বীকৃতিহীন লাখ লাখ রোহিঙ্গার মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তার প্রভাবশালী ভূমিকাকে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের নিরিখেও বিবেচনা করবে_ শান্তিকামী মানুষ মাত্রই তা চাইবেন। যদি ফিলিস্তিনিদের মতো মিয়ানমারেও ধর্মীয় বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্রহীন করে রাখা হয়, তা হবে মর্মান্তিক।
অং সান সু চির মতো জননেত্রী যে তার দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস জানেন না_ এমন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তিনি সবকিছু জেনেশুনেই এক উভয় সংকট থেকে সে দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে এমন সাময়িক মন্তব্য করেছেন_ এমন ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করে। হয়তো দেশের সামরিক জান্তার হাত থেকে জনরায়ে ক্ষমতা পেয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরে তিনি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু সে আশা কল্পনাই হয়ে থাকে শুধু, তিনি যখন বলেন, 'প্রতিটি সরকারের উচিত নাগরিকত্বের আইন বিষয়ে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা। মিয়ানমারে ৮ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। সরকারের দাবি, তাদের বেশির ভাগই পার্শ্ববর্তী দেশ (বাংলাদেশ) থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী।'
অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ তথ্য সত্য নয়। আমরা জানি, ধর্ম মানুষের প্রধান পরিচয় নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে মৌলবাদী ধর্মান্ধরা মানুষকে ধর্মের বাটখারা দিয়ে মেপে মানবতার লাঞ্ছনাই বাড়াচ্ছে দেশে দেশে। বাংলাদেশে যারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে রাজনীতি করছেন, তাদেরকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত করে এ দেশেও সহিংসতা সৃষ্টি করছেন, তাদের ধিক্কার জানাই। পাশাপাশি যুগ যুগ ধরে যারা বার্মা বা মিয়ানমারে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে একটি জনগোষ্ঠীকে তার জন্মমৃত্তিকা থেকে উচ্ছেদ করছে, নৃশংসভাবে হত্যা-নির্যাতন এবং মৌলিক মানবাধিকারগুলো কেড়ে নিচ্ছে, তাদেরও ধিক্কার জানাই। আমরা মানবতার প্রবক্তা অং সান সু চিকেও সবিনয়ে বলতে চাই, ভোটের হিসাব কষে সামরিক জান্তার পাতা ফাঁদে দয়া করে পা দেবেন না। ইতিহাসের দিকে একবার ফিরে তাকান।
আপনার তো অজানা নয় যে, ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইলের 'রোহিঙ্গা' বা 'রোসাঙ্গ' স্বাধীন রাজ্যই ছিল। রোহিঙ্গারাই শাসন করত সে রাজ্য। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া তা দখল করার পরই না বৌদ্ধ আধিপত্য আর দিনে দিনে তাদের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
সু চির অজানা নয়_ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা যখন ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা পেয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রে যাত্রা শুরু করে, তখনও পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। বেশ কয়েকজন সরকারি পদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেছেন। সবকিছু তো উল্টে গেল ১৯৬২ সালে। গণতন্ত্র হত্যা করলেন জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। তারপর থেকেই না মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া হলো রোহিঙ্গাদের। ভোটাধিকার হরণ করা হলো। মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার, শিক্ষা গ্রহণেরও সুযোগ নেই। জন্মনিবন্ধন হয় না। বিয়ে করতে অনুমতি নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশের অধিকারও নেই। রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে কতই না কঠোর আইন আপনার দেশে! সু চি, আপনি কি দয়া করে ইতিহাসের দিকে একবার তাকাবেন? আপনি কি নিশ্চিত নন যে, বর্তমান সামরিক শাসকরা দেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায় আর বহির্বিশ্বেও আপনার অগণিত অনুরাগীর কাছে আপনাকে চরম বিতর্কিত করার মতো এক অগি্নপরীক্ষায় ফেলতে চায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে? আপনি কি মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে বৌদ্ধদের খুশি করবেন, নাকি মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়াবেন সংখ্যালঘুদের বাঁচাতে।

নাসির আহমেদ :কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.