ওবামার মিয়ানমার সফর-রোহিঙ্গা সমস্যার যথার্থ সমাধানই কাম্য

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গতকাল শনিবার থেকে তাঁর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর শুরু করেছেন। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার পর আগামীকাল সোমবার তিনি মিয়ানমার পৌঁছবেন। আর মিয়ানমারে এটিই হবে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথম সফর। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, এ সময় তিনি দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন।


তিনি সেখানকার জাতিগত দাঙ্গায় উসকানিদাতাদের বিচার নিশ্চিত করারও দাবি জানাবেন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে মার্কিন কূটনীতিকরা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডারসেক্রেটারি মারিও ওটেরোর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত শনিবার কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ওবামার সফরেও তা যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে।
অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মিয়ানমার সফরের প্রাক্কালে গত শুক্রবার মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক দাঙ্গার জন্য জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের দায়ী করেছেন। এর পেছনে কয়েকটি বিদেশি সংস্থা ও রাষ্ট্র জড়িত বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। দেশে শান্তি বজায় রাখতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিককে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। একই দিনে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের উদ্দেশে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন থেইন সেইন। চিঠিতে রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা, রাখাইনদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিদান ও তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় তাঁর সরকার অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। মিয়ানমার সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ।
রোহিঙ্গারা কয়েক শতাব্দী ধরে মিয়ানমানের রাখাইন রাজ্যে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, হাজার বছর আগে থেকেই সেখানে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠে। কিন্তু স্থানীয় বৌদ্ধ রাখাইন সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী বলে অভিযোগ করে আসছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে সেখানকার রোহিঙ্গারা সব ধরনের অধিকারবঞ্চিত অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এর ওপর চলে রোহিঙ্গাদের জানমালের ওপর হামলা। সরকারি হিসাবেই গত অক্টোবর মাসের জাতিগত দাঙ্গায় সেখানে ৮৯ জন নিহত হয়েছে। এ অবস্থায় জীবন বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। গত তিন দশকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে এই ভার বহন করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয়ের কারণে কক্সবাজার জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে আর্থসামাজিক পরিবেশও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে টেকনাফ গেম রিজার্ভসহ সেখানকার সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব কারণে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে বৈরী মনোভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে তা রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে। আবার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এতে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে এ দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিশেষ করে হরকাতুল জিহাদ বা হুজির সম্পর্ক নিয়ে ইতিপূর্বে পত্রপত্রিকায় বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান বাংলাদেশের জন্যও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আর এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যে উদ্যোগ নিয়েছে, বাংলাদেশকে সেই সুযোগ নিতে হবে। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ওপর চেপে থাকা রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী যথার্থ সমাধানে সচেষ্ট হতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.