বিদ্যুতের দাম আবার বাড়াতে চায় বিতরণ সংস্থাগুলো by আরিফুজ্জামান তুহিন

এক মাসের ব্যবধানে আবারও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো। চারটি বিতরণ প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা পড়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে। এ চারটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ৯ থেকে ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।


এগুলোর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বিদ্যুতের দাম ৯ শতাংশ বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রাহকের নূ্যনতম মাসিক বিল ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করতে চায়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ১২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব শিগগিরই জমা দেবে কমিশনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ালে জনগণের নাভিশ্বাস উঠবে।
বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বিতরণ কম্পানির দেওয়া প্রস্তাব সম্পর্কে বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ইমদাদুল হক বলেন, 'আমরা প্রস্তাব পেয়েছি। যেসব বিষয় দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে কম্পানিগুলোর দেওয়ার কথা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।' কবে নাগাদ দাম বাড়ার প্রস্তাব আমলে নেওয়ার জন্য উন্মুক্ত সভা হবে জানতে চাইলে প্রকৌশলী ইমদাদুল হক বলেন, 'এখন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। এ কাজটি শেষ হলে তখন সময় নির্ধারণ করা যাবে।'
জানা যায়, সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে গড়ে ১৬ দশমিক ৯২ এবং খুচরা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দামের পার্থক্য হওয়ায় বিতরণ কম্পানিগুলো লোকসানের মুখে পড়ে। বিতরণ কম্পানিগুলোর লোকসান ঠেকাতে খুচরা বা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তারা। বিতরণ কম্পানিগুলোর দাবি, দাম সমন্বয় না হলে প্রায় এক হাজার ৬৮০ কোটি টাকা লোকসান হবে।
বিইআরসি সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠ দফায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল, যা কার্যকর হয়েছে ওই মাসের ১ তারিখ থেকে।
জানা যায়, বিইআরসির কাছে সাড়ে ১০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি (ওজোপাডিকো)। কম্পানিটির দাবি এ পরিমাণ দাম না বাড়ালে ৯৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা লোকসান হবে তাদের। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ১১ দশমিক ৩১ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে বলেছে, তা না হলে ৩২৫ কোটি টাকা লোকসান হবে তাদের। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানি (ডেসকো) ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে এর মাধ্যমে প্রায় ১০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি কমানোর আবেদন করেছে। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) লোকসান ঠেকাতে ৯ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব রেখেছে। এ পরিমাণ দাম না বাড়ালে এ কম্পানিটির ৬৪৫ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে দাবি করেছে তারা।
পিডিবি এখনো প্রস্তাব জমা দেয়নি। তবে পিডিবি ১২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করছে বলে জানা গেছে। তা না হলে এ প্রতিষ্ঠানটিও ৫১৬ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়বে বলে কর্মকর্তারা জানান।
জানা যায়, বিতরণ কম্পানিগুলোর দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়ানো না হলেও মূল্য সমন্বয় করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে জ্বালানি সহায়তা তহবিল থেকে সরকারকে লোকসানের পরিমাণ অনুসারে বিতরণ কম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দিতে হবে।
আরইবির প্রস্তাব : শেষ দফায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল পল্লী বিদ্যুতের (আরইবি)। এবার দাম না বাড়ানো পর্যন্ত পল্লী বিদ্যুতের বার্ষিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ভর্তুকি হিসেবে ৫৩৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গ্রাহকদের নূ্যনতম মাসিক বিল ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ একবার স্থগিত রাখার অনুরোধও করেছে আরইবি।
২০১০-১১ অর্থবছরে আরইবির সমিতিগুলোর লোকসানের পরিমাণ ছিল প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে ৪২ পয়সা। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ষষ্ঠ দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ার পরও আরইবির দাবি, তাদের প্রতি ইউনিটে ঘাটতি ৫০ পয়সা। চলতি অর্থবছরে এ লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৪৫ কোটি টাকা। এই লোকসান কাটিয়ে ওঠার জন্যই প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
সূত্র জানায়, আরইবির ৯১ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সেচ গ্রাহক দুই লাখ ৬০ হাজার। অন্যরা আবাসিক গ্রাহক। আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে ৬৮ লাখই সরকার ঘোষিত লাইফলাইন শ্রেণীর (০-১০০ ইউনিট ব্যবহারকারী)। আরইবির প্রস্তাব গৃহীত হলে এ শ্রেণীর বিদ্যুতের দাম এক লাফে ৬৫ টাকা থেকে ১০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাব অনুযায়ী আরইবির বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে ধান উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। এতে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়বে।
বিইআরসি সূত্র জানায়, বরাবরই আরইবির গ্রাহকরা অন্য গ্রাহকদের তুলনায় বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে থাকেন। ষষ্ঠ দফায় পিডিবি, ডিপিডিসি, ডেসকো ও ওজোপাডিকো বিদ্যুতের দাম একই রকম রাখা হয়; বৈষম্যের শিকার হয়েছেন শুধু আরইবির গ্রাহকরা। গত ২০ সেপ্টেম্বর ঘোষিত বিদ্যুতের নতুন দামে দেখা গেছে, প্রথম ধাপেই আরইবির গ্রাহকরা অন্য গ্রাহকদের চেয়ে ৩৩ পয়সা বেশি দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনছেন। নতুন করে আরইবির বিদ্যুতের দাম বাড়লে প্রথম ধাপেই ইউনিটপ্রতি দাম পড়বে ৪ টাকা ৫ পয়সা, যা অন্য কম্পানির দামের চেয়ে ৭২ পয়সা বেশি।
ভোক্তার অধিকার রক্ষা প্রতিষ্ঠান কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বড়লোকের কমে, গরিবের বাড়ে- এটা তো পত্রিকায় (কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন অনুযায়ী) খবর হয়েছে। ধাপ ভেঙে নতুন নিয়ম করায় গতবার ধনীদের বিদ্যুতের দাম কমেছে, বেড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের বিদ্যুতের দাম।'
বর্তমান সরকারের মেয়াদে বিদ্যুতের দাম ছয়বার বেড়েছে। সব মিলিয়ে পাইকারি পর্যায়ে বেড়েছে ৯৮ দশমিক ৩১ এবং গ্রাহক পর্যায়ে পাঁচ বারে ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই বেড়েছে তিনবার। সর্বশেষ দাম বাড়ানোর আগে পাইকারি পর্যায়ে গণশুনানি হলেও গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয় অন্তর্বর্তী আদেশে।

No comments

Powered by Blogger.