কদলী প্রজাতন্ত্র by শেখ রোকন

'লিভিং হিস্ট্রি' যারা পড়েছেন, তাদের মনে থাকার কথা, বিল ক্লিনটনের সঙ্গে প্রথম দেখার দিনটিতে ইয়েল শিক্ষার্থীর জটলায় কলার প্রসঙ্গ হিলারি ও তার বান্ধবীদের কীভাবে বিব্রত করেছিল। বস্তুত জনপ্রিয় এই ফলটি আবহমান কাল থেকেই দেশ ও ভাষা নির্বিশেষে খাদ্য ও পুষ্টি-বিচ্ছিন্ন নানা উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।


বাংলা ভাষাতেও কলা হচ্ছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা ও অকিঞ্চিৎকর কিছুর প্রতিশব্দ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও 'বানানা রিপাবলিক' বলতে সাধারণত এমন রাষ্ট্রকে বোঝায় যা নানা ব্যবসায়িক স্বার্থ, শ্রেণী সংঘাতে জেরবার।
কলার এই সাংস্কৃতিক দুর্দিন বোধহয় ফুরোতে চলছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিজিআইএআরের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কলা হতে পারে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের সংকটকালীন খাদ্য। ধারণা করা হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি ক্যালরি সরবরাহকারী খাদ্যের প্রধান তিনটি_ ভুট্টা, চাল ও গমের উৎপাদন হ্রাস পেয়ে বিভিন্ন জাতের কলার ফলন ভালো হবে। আর ভালো ফলবে আফ্রিকান কাসাভা ও কাউপি।
বিদেশি গবেষকদের এই বার্তা বাংলাদেশের জন্য মন্দ কী! কাসাভা আর কাউপি গোল্লায় যাক; এ দেশে কলার কদর কখনোই কম ছিল না। এখন কেবল অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে মেনে নিতে রুচিগত সামান্য সমস্যা উপেক্ষা করতে পারলে হলো।
ফল হিসেবে কলা কেবল নয়, ওই গাছের বিভিন্ন অংশের যে বিচিত্র ব্যবহার গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে দেখি আমরা, সেটাই-বা আর কোথায় মেলে? পেটের গড়বড়ে গ্রামাঞ্চলে বিচি কলা হচ্ছে অব্যর্থ ওষুধ। কাঁচাকলার তরকারির জনপ্রিয়তা যে কোনো সবজিকে হার মানায়। কলার মোচা আর থোড়ের তরকারি, সেও মহারানী। রাজধানীর সুপার স্টোরগুলোতে দোর্দণ্ড প্রতাপে জায়গা করে নিয়েছে।
কলার ঢোঙা (বাকল) আর পাতারই কী ব্যবহারিক বাহার! গ্রামের হাট-বাজারে পলিথিনের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত লবণের দোকানে কলার পাতা কিংবা ঢোঙার ঠোঙা ছাড়া গতি ছিল না। এখন যে 'সবুজ' বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে তা বাস্তবায়ন করতে হলে কলাগাছের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় কী?
কৃষির কথা বলা যাক। বন্যায় যখন মাঠের কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই, তখন গৃহস্থের গরুর খাদ্য কিন্তু কলার পাতাই। পানি নেমে যাওয়ার পর নদী অববাহিকার অত্যন্ত নরম জমি সমান করতে প্রথাগত মইয়ের বদলে কলাগাছ এগিয়ে আসে। কলার ভেলার কথাও ভোলা যাবে না। যেসব অঞ্চলে সারাবছর নৌকার প্রয়োজন হয় না, বন্যায় তারা পারাপারের জন্য কলাগাছের ভেলা বানিয়ে নেয়। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কলার পাতা হচ্ছে গরিবের ছাতা। হতদরিদ্রের মাথার ছাদ।
আমাদের দেশে কলার সাংস্কৃতিক গুরুত্বও দড়ো। বাঙালি হিন্দুর পূজা ও পার্বণ কি কলা ও কলাগাছ ছাড়া সম্পন্ন হয়? হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জায় কলার গাছ ও পাতা অনিবার্য অনুষঙ্গ। শ্রাদ্ধ কিংবা চলি্লশা_ যেখানে শত শত মানুষের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার জড়িত, সেখানে কলাপাতা ছাড়া সামাল দেওয়া কঠিন। বর্ষার পানিতে কলার মোচার নৌকা ভাসানো কিংবা দূর্বা ঘাসে শিউলি ফুলের মতো পড়ে থাকা কদলী ফুল কুড়ানোর শৈশবই-বা আমরা ভুলব কী করে? কলার জাতবৈচিত্র্য, স্বাদ ও নাম? আহা! সেও এক কাণ্ড রামায়ণ।
সব মিলিয়ে, তত্ত্বগত অর্থ যাই হোক; ব্যবহার বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ সত্যিই 'কদলী প্রজাতন্ত্র'। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যদি কলার প্রতি নির্ভরতা বাড়ে, এ দেশের মানুষ খুশি না হোক, বোধহয় বেজার হবে না।
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.