ঐতিহ্য- আর কত দায়িত্বজ্ঞানহীন থাকব আমরা? by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

‘লেট লতিফ’ শিরোনামে বহুল প্রচলিত একটি গল্প চালু আছে। গল্পটি কলকাতার মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের একসময়ের জনপ্রিয় ফুটবলতারকা আবদুল লতিফকে নিয়ে। তিনি নাকি খেলার মাঠে কখনোই শিডিউল অনুযায়ী উপস্থিত হতে পারতেন না। বিলম্বে উপস্থিতি তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।


ভালো খেলোয়াড় ছিলেন বলে সবাই এটিকে সহজভাবেই গ্রহণ করতেন। বাঙালি সমাজ খেলোয়াড় আবদুল লতিফের ওই অভ্যাস(?) স্মরণে রেখেছে। কোথাও কেউ শিডিউল অনুযায়ী কাজে অংশ নিতে অপারগ হলে তাঁকে ‘লেট লতিফ’ বিশেষণে সম্বোধিত করা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে তো বটেই, সরকারি মহলেও ‘লেট লতিফ’দের ঘটনা ঘটছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে উপস্থাপিত একটি সংবাদ জেনে ওই গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্যসম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার আইন (ট্রিপস) বাংলাদেশে যথাসময়ে প্রণয়ন না করায় বিরাট একটা ক্ষতি হয়ে গেছে। ওই আইন না থাকার সুযোগে ভারত বাংলাদেশের জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা ও ফজলি আম নিজেদের পণ্য হিসেবে পেটেন্ট করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় নিবন্ধিত করে নিয়েছে। ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’ আন্তর্জাতিক আইন ভারত ১৯৯৯ সালেই তৈরি করে রেখেছিল। পক্ষান্তরে দেশে তা না করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পণ্য তিনটি বাংলাদেশের গৌরবের, সেগুলোর তো এমন দুরবস্থা হওয়ার কথা নয়।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, পেরিপ্লাস অব ইরিথ্রিয়ান সি গ্রন্থে এবং আরব, চীন ও ইতালীয় পর্যটক এবং ব্যবসায়ীদের বৃত্তান্তে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রশিল্পের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পেরিপ্লাস-এ লেখা হয়েছে, স্কটুল্যাটস জামদানি ছিল জগদ্বিখ্যাত। এই জামদানি তৈরি হতো ঢাকাতেই। ‘ঢাকাই জামদানি’ নামেই তা পরিচিত ছিল। ঢাকার পূর্ব দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পারে কয়েক বর্গমাইল এলাকায় তৈরি হতো ওই জামদানি। ইন্ডিয়ান আর্টস গ্রন্থে পণ্ডিত জেমস ওয়াট লিখেছেন, ঢাকাই জামদানি উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম শিল্পকর্ম ছিল। দিল্লির মোগল সম্রাটদের খুবই প্রিয় ছিল এই ঢাকাই জামদানি শাড়ি। সম্রাট আওরঙ্গজেব ৩১ পাউন্ডে যে ঢাকাই জামদানি ক্রয় করেছিলেন, তার দলিল রক্ষিত আছে দিল্লির মোগল মহাফেজখানায়। টপোগ্রাফি অব ঢাকা বইয়ে জেমস টেলর সাহেব লিখেছেন, ঢাকাই জামদানির একচেটিয়া উৎপাদক ছিল মুসলমান কারিগরেরা। এই জামদানি শাড়িতে প্রতিফলিত হয়েছে নিরাভরণ বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবজগৎ, বৃক্ষ, লতাগুল্মের নকশা। জামদানি শাড়িতে বারবার ঘুরে এসেছে ধানের শীষ, ঘাসফুল, পুনাফুল, তারাফুল প্রভৃতির মোটিফ। এসব নকশা ঢাকাই জামদানিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে। অপর দিকে নকশিকাঁথা ছিল বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও অতুলনীয় লোকশিল্প। ফরিদপুর-যশোরের নকশিকাঁথা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য বহির্বিশ্বে খ্যাতিমান হয়ে আছে। ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী সর্বজনশ্রদ্ধেয় পল্লিকবি জসীমউদ্দীন তো এ কারণেই নকশিকাঁথাকে স্মরণীয় করে রাখতে নক্সীকাঁথার মাঠ কাহিনিকাব্য রচনা করেছিলেন। অপর দিকে রসনাপ্রিয় বাঙালির কাছে রাজশাহীর ফজলি আম তো একেবারে তুলনাহীন।
ভৌগোলিক নির্দেশক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আইনে যেমন পেটেন্ট হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে ‘ফ্লোরিডার কমলা’, ‘ওয়াশিংটনের আপেল’, ‘ফ্রান্সের মদ’; তেমনি এখনো সুযোগ আছে ‘ঢাকাই জামদানি’, ‘ফরিদপুর-যশোরের নকশিকাঁথা’ আর ‘রাজশাহীর ফজলি আম’ সেই অধিকার অর্জনের। ২০১২ সালের মে মাসে শেষ হয়ে যাওয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব অধিকার আইন প্রণয়নের সময়সীমা ২০১৩ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ রয়েছে। অতি দ্রুতই ওই আইন প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আরেকটি বড় কথা হলো, মেধাস্বত্ব আইনের আওতাভুক্ত রয়েছে চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, সংগীতশিল্প, সংগীত, অভিনয়শিল্প ইত্যাদি বিষয়। মেধাস্বত্ব আইন প্রণীত না হলে একদিন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম, সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ ও আবদুল আলীমের কণ্ঠসংগীতের মেধাস্বত্ব নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর ময়মনসিংহর কিশোরগঞ্জে। কিন্তু চিত্রশিল্পী হিসেবে খ্যাত হয়েছেন কলকাতায় গিয়ে। কলকাতায় তিনি চিত্রশিল্প নিয়ে পড়ালেখা করেন, পরে শিক্ষকতাও করেন। তাঁর অনেক কালজয়ী চিত্রকর্ম কলকাতায়ই আঁকা। এ সময়ই তিনি নন্দিত হন বহির্বিশ্বে। জয়নুল দেশে ফিরে ঢাকায় আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং চিত্রশিল্প নিয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। এখন যদি জয়নুলের খ্যাত হওয়ার স্থান ভৌগোলিক নির্দেশক আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করে অন্য কোনো দেশ স্বত্ব দাবি করে, তাতে সমূহ বিপত্তির আশঙ্কা রয়েছে। অনুরূপ, ভারত মেধাস্বত্ব অধিকার দাবি উত্থাপন করতে পারে সুরশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ এবং শিল্পী আবদুল আলীমের বিষয়েও। কারণ, এঁরা দুজনই জন্মেছিলেন ভারতে। তবে এঁদের মেধার বিকাশ ঘটেছে বাংলাদেশে আসার পর। তবু ওই দাবি আসতে পারে ধ্রুপদি শিল্পকলার পাথরের তৈরি ভাস্কর্য নিয়েও। পশ্চিম দিকে মহানন্দা আর পূর্বে করতোয়া নদীর বিশাল অঞ্চল নিয়ে প্রাচীন বরেন্দ্রভূমি।
নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজত্ব করেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা। এই রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও বদান্যতায় বাংলার ভাস্কর্যশিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়। ‘বঙ্গীয় ভাস্কর্য’ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত ও খ্যাত পাথরের তৈরি দেব-দেবীর বিপুল পরিমাণ মূর্তি তৈরি হয়েছে এখানে। এ দেশে পাথর পাওয়া যেত না বলে মূর্তি তৈরির জন্য তা আনা হয়েছে বিহারের রাজমহল ও ছোটনাগপুর পাহাড় থেকে। বরেন্দ্রভূমি ভাস্কররা সেই পাথর দিয়ে শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসন মেনে মূর্তি তৈরি করেছেন। এসব শিল্পীর কজনের নামোল্লেখ করেছেন ঐতিহাসিক লামা তারনাথ, তিব্বতি ভাষায় লেখা ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস গ্রন্থে। তারনাথ লিখেছেন পাল আমলে ধীমান ও বীতপাল এবং সেনরাজ বিজয় সেনের শাসন আমলে বরেন্দ্র শিল্পীগোষ্ঠী চূড়ামণি রাণক শূলপাণির কথা। ব্ল্যাক ব্যাসাল্ট, ব্ল্যাক ক্লোরাইট প্রভৃতি কালোপাথরের তৈরি সেসব শিল্পকর্ম বঙ্গীয় শিল্পকলার অতুলনীয় নিদর্শন হিসেবে খ্যাতিলাভ করে আছে। এসব শিল্পকর্ম ‘বরেন্দ্র ভাস্কর্য’ হিসেবে ভৌগোলিক নির্দেশক আইনের আওতায় এনে বিপর্যয় রোধ করতে নিবন্ধিত করা একান্ত জরুরি।
এ জন্য চারদিক দেখে-শুনেই বৈশ্বিক মানসম্পন্ন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব আইন প্রণয়ন করতে হবে। আইনে ফাঁকফোকর থাকলে তা হবে দেশের জন্য আত্মঘাতী ঘটনা। বিলম্ব নয়। ‘লেট লতিফের’ আর কোনো কাহিনি শুনতে চায় না বাংলাদেশের মানুষ।
 ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী, গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.