বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৬৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শমসের মবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম সাহসী প্রতিরোধযোদ্ধা
১৯৭১ সালে শমসের মবিন চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট।


মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধযুদ্ধকালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের যুদ্ধে তিনি আহত হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে বন্দী করে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ঘটনা, কালুরঘাট যুদ্ধ ও বন্দী জীবনের ঘটনার কথা জানা যাক তাঁর নিজ বয়ানে (১৯৭৩)।
‘২৫ মাচ ব্রিগেডিয়ার আনসারি (পাকিস্তানি) আমাদের সিওকে (অধিনায়ক) নির্দেশ দিলেন আমরা যেন ব্যারিকেড পরিষ্কার করি।...আমরা ব্যারিকেড পরিষ্কার করতে গেলাম। (এরপর) ষোলশহর থেকে বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত ডিউটি করার জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হলো।
‘রাত ১২টায় ষোলশহর ক্যান্টনমেন্টের গেটে গিয়ে গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। বৃষ্টির মতো গুলি।...এমন সময় কিছু বাঙালি সেনাকে গেটের কাছে দেখলাম। তাঁরা বললেন, “স্যার, বালুচ রেজিমেন্ট আমাদের ওপর হামলা করেছে এবং অনেককে মেরে ফেলেছে।” আমি সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে ষোলশহরে এইট বেঙ্গলে গেলাম।
‘সেখানে গিয়ে শুনলাম সকল পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৬ মার্চ ভোরে আমরা কালুরঘাটের একটু দূরে পৌঁছলাম। কালুরঘাটে আমরা শপথ গ্রহণ করলাম। “বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।” শপথবাক্য পাঠ করান মেজর জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, সেনাপ্রধান, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি)।
‘১১ এপ্রিল সকাল আটটার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী কালুরঘাটে ভীষণ আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে। আমি ও মেজর হারুন (বীর উত্তম, তখন ক্যাপ্টেন, পরে মেজর জেনারেল) আমাদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমাদের সেনাসংখ্যা ছিল ৩৫ জন। ওদের (পাকিস্তানি) ছিল ১০০-এর ওপরে। আমাদের একজন সেনা এ যুদ্ধে মারা যান।
‘মেজর হারুন ব্রিজের ওপর আহত হন। আহত হওয়ার পর তাঁকে অতি কষ্টে পুলের অপর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে (মুক্তিযোদ্ধাদের) পিছু হটতে নির্দেশ দিলাম। আমাকে একজন সেনা (মুক্তিযোদ্ধা) চলে যেতে বলল। আমি বললাম, ‘তোমরা যাও, আমি আসছি।’
‘আমি রয়ে গেলাম। হঠাৎ আমি নিজেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘেরাও অবস্থায় দেখলাম। অন্য সবাই পুলের অপর পারে চলে যেতে সক্ষম হয়। আমি ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে চারদিকে চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করলাম। চোখের সামনে তিনজন পাকিস্তানি সেনাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। তারপর একটা গুলি এসে আমার কোমরে লাগে। আমি গুরুতরভাবে আহত হয়ে পুলের ওপর পড়ে গেলাম।
‘আমি ভাবতে থাকলাম শত্রুরা আমাকে ধরে ফেলবে। আমি ওদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মহত্যা করে মৃত্যুকে শ্রেয় বলে স্থির করলাম। কিন্তু স্টেনগানটা দূরে ছিল। তাই এটা সম্ভব হলো না। আমি ভাবছিলাম ওরা আমাকে ধরে মেরে ফেলবে। কিন্তু শত্রুরা আমাকে ধরে নিয়ে যায় এবং বন্দী করে রাখে।
‘তারপর আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়। বন্দী শিবিরে রাখা হয় এবং (আমার ওপর) অশেষ নির্যাতন চালানো হয়। প্রত্যহ আমাকে মারধর করা হতো। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আমাকে রাখা হয়। আমার সঙ্গে আরও অনেক বন্দী ছিল। জুন মাস পর্যন্ত অত্যাচার চলে। নভেম্বর মাসে আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট আনা হয়। বলা হয়েছিল কোর্ট মার্শাল করা হবে। কিন্তু ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আমি মুক্ত হয়ে যাই।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শমসের মবিন চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২১।
শমসের মবিন চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত থাকাকালে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে পররাষ্ট্রসচিব পদে উন্নীত হন এবং পরে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির (বিএনপি) সঙ্গে যুক্ত। তাঁর পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলায় (গ্রাম ভাদেশ্বর)। বাস করেন ঢাকায় (১৯ পার্ক রোড, অ্যাপার্টমেন্ট বি ৪, বারিধারা)। তাঁর বাবার নাম আবদুল মবিন চৌধুরী, মা তাহমেদুন নাহার। স্ত্রী শাহেদা ইয়াসমিন। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.