চরাচর-আগরতলা মামলার স্মৃতি বিজড়িত বঙ্গবন্ধু জাদুঘর by কেয়া চৌধুরী

ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা চলাকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসের যে ভবনে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল, তার অনতিদূরেই তৎকালীন সিগন্যাল অফিসার মেসের একটি কক্ষকে বিচারালয়ে রূপান্তর করে সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আগরতলা মামলার বিচারকাজ।


পরবর্তীকালে এর পুরোটাতেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় 'আগরতলা মামলার স্মৃতিবিজড়িত বঙ্গবন্ধু জাদুঘর'। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সশস্ত্র যুদ্ধের সঠিক বিবরণ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বিজয়কেতন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র, কামান ও গোলাবারুদ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৭৪ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৬ সালের ৬ জুলাই এর ভিত্তি স্থাপন করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান; এবং জাদুঘরটি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে, ২০০০ সালের ২১ নভেম্বর। ঢাকা সেনানিবাসের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিজয়কেতন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সুদৃশ্য ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে জাদুঘর প্রাঙ্গণের মাঝে প্রথমেই চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য 'বিজয়কেতন'। বামে উত্তর সীমানা বরাবর রয়েছে টেরাকোটায় উৎকলিত দেয়াল ভাস্কর্য 'সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা'। দক্ষিণ পাশে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র বিধৃত টাইলস ম্যুরাল 'আলোর প্রতিধ্বনি'তে। মাঝে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা সৌন্দর্যমণ্ডিত একতলা জাদুঘর ভবন, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রদর্শনসামগ্রী এবং স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধের বিবরণসহ ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের ওপর আরোপিত চার্জশিট, গুরুত্বপূর্ণ ছবি এবং একমাত্র আলামত হিসেবে মামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষিত রয়েছে। জাদুঘর চত্বরের উত্তর সীমানা বরাবর ৮০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট বিশাল দেয়ালজুড়ে রয়েছে অপূর্ব শিল্পকর্ম টেরাকোটা রিলিফ ম্যুরাল। দক্ষিণ পাশের আরেকটি দেয়ালজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এবং বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিত্র ও ম্যুরাল। জাদুঘরে মোট ছয়টি কক্ষে প্রদর্শন সামগ্রীর মধ্যে পাঁচটিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন পর্যন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলি, প্রামাণ্য দলিল, ছবি, ম্যাপ ও স্কেচসহ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও পাঁচটি মূল্যবান কামান। জাদুঘরের একটি আকর্ষণীয় এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার বিচার যে কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল রুমটি ঠিক আগের মতো করে আসবাবপত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো রয়েছে। বিচারকের এজলাস, সাক্ষী বা আসামির কাঠগড়া, আসামিদের ঘেরাও করা বসার স্থান ইত্যাদি। ১৯৬৮ সালে দায়ের করা মামলায় যার নাম ছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য', অভিযুক্ত আসামি ৩৫ জনের স্মৃতিবিজড়িত সেই ঐতিহাসিক কক্ষটি আমাদের জন্য এখনো একটি জীবন্ত ইতিহাস। উল্লেখ্য, মামলাটি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন এর বিচারকাজ শুরু এবং চার্জশিট দেওয়া হয়। আমাদের এ প্রজন্মের প্রত্যেকেরই জাদুঘরটি মনোযোগসহকারে দেখে আসা উচিত। তবেই আমরা স্পর্শ করতে পারব আমাদের পূর্বপুরুষের বীরত্বগাথার ইতিহাস।

No comments

Powered by Blogger.