সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-দ্বিতীয় মেয়াদে ওবামা :চ্যালেঞ্জ থেকে সুবর্ণরেখা by মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

বাংলাদেশসহ প্রায় সারাবিশ্বে স্বস্তি ফেরানোর জয় পেলেন আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ পিতা ও আমেরিকান গৌরাঙ্গ মাতার কৃতী সন্তান বারাক হোসেন ওবামা। ৬ নভেম্বর নির্বাচনটি ছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, সবচেয়ে ব্যয়বহুল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনিশ্চিত এবং যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চল লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির ঠিক পরপর।


চৌকস বক্তা, সুদর্শন, সংখ্যাগরিষ্ঠ গৌরাঙ্গ মার্কিনিরা, বিশেষ করে বিত্তবানদের দৃঢ় সমর্থনে মিট রমনিকে তীব্র প্রতিযোগিতায় হারিয়ে ওবামার চমৎকার বিজয়ে গণতান্ত্রিক বহুজাতীয়তা ও বহুমাত্রিকতা, যুদ্ধ নয় শান্তি, হুমকির পরিবর্তে আলোচনা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সরকারের একটি নিয়ামকমূলক (রেগুলেটরি) ভূমিকার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৩-১৬ সালে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্সির চলার পথটি মোটেও কুসুমে সজ্জিত নেই। আছে বাধা, আছে কণ্টক। কিন্তু সব ছাপিয়ে আছে বিশ্ব অর্থনীতির গা-ঝাড়া দেওয়া শক্তিশালী পুনরুত্থানের বিপুল সম্ভাবনা। তবে সে পথপরিক্রমায় প্রেসিডেন্ট ওবামাকে অবশ্যই রিপাবলিকান পার্টির সমর্থন আদায় করতে হবে নিজ দল ডেমোক্র্যাটদের আস্থা অক্ষুণ্ন রেখে। রিপাবলিকানদেরও এগিয়ে আসার কারণ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা একটি কঠিন ভারসাম্যমূলক গণতন্ত্র, যার অন্তর্নিহিত চেক-ব্যালেন্স প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে অচলায়তন সৃষ্টি করতে পারে, যেমনটি এখন বিদ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগের অসীম ক্ষমতার কথা স্মরণে রেখেও বলা যায় যে, নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট এবং আইন প্রণয়নের অঙ্গ কংগ্রেসের কেউই অন্য পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া এককভাবে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারে না। কংগ্রেসের দুটি কক্ষ_ নিম্নকক্ষে অর্থাৎ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন কংগ্রেস সদস্য চার বছর পরপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ই নির্বাচিত হন। আর উচ্চকক্ষ সিনেটের ১০০ জন সিনেটর একটি ধারাবাহিকতা রক্ষা করে প্রতি দুই বছর পরপর এক-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত হন। এই ১০০ জন সিনেটর, ৪৩৫ জন কংগ্রেসম্যান ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির (ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া) ৩ জন প্রতিনিধিত্বকারী, মোট ৫৩৮ জন ডেলিগেট, যারা প্রতি চার বছর পর নভেম্বরের প্রথম মঙ্গলবার (এবার যেমন ছিল ৬ নভেম্বর মঙ্গলবারের নির্বাচন) সাধারণ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে ইলেক্টোরাল কলেজ সৃষ্টি করেন। ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসিতে হাতি মার্কা (রিপাবলিকান) ও গাধা মার্কায় (ডেমোক্র্যাট) নির্বাচন করেন দুই প্রধান দলের কনভেনশনের মাধ্যমে মনোনীত প্রার্থী দু'জন।
ভোটের দুটি তাৎপর্য। প্রদত্ত সব ভোটের কত অংশ (শতকরা হিসাবে) কোনো দলীয় প্রার্থী পেলেন তাকে পপুলার ভোট বলা হয়। যেমন_ ২০১২ সালের নির্বাচনে ফ্লোরিডা বাদে অন্য সব ভোটের শতকরা ৪৯ দশমিক ৮ ভাগ পেয়েছেন বারাক ওবামা ও শতকরা ৪৭ দশমিক ৫ ভাগ ভোট পেয়েছেন মিট রমনি। প্রেসিডেন্ট কিন্তু নির্বাচিত হবেন ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ যে প্রার্থী ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পাবেন, তিনিই হবেন পরবর্তী চার বছরের জন্য সবচেয়ে শক্তিধর ও সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এবার যেমনটি এ পর্যন্ত ৩০৩টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী বারাক ওবামা। প্রায় সব হিসাবেই তিনি ফ্লোরিডাতেও জয়ী হবেন (২৯টি ইলেক্টোরাল ভোট) এবং সর্বমোট ৩৩২টি ইলেক্টোরাল ভোট পাবেন। মিট রমনিকে ২০৬টি ইলেক্টোরাল ভোট নিয়েই পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। পপুলার ভোটে ওবামা সম্ভবত শতকরা ৫১ ভাগ ভোটপ্রাপ্ত হবেন। অতীতে অন্তত তিনটি নির্বাচনে পপুলার ভোটে শতকরা ৫০ ভাগ ভোটের কম পেয়েও ইলেক্টোরাল কলেজের সংখ্যাধিক্যের (২৭০ ভোট) ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন (২০০০ সালে জর্জ বুশ) পপুলার ভোটে পরাজিত হয়েও। কাজেই ইলেক্টোরাল ভোটই নিয়ামক শক্তি।
চার বছরের শাসনামলে প্রেসিডেন্টের যে কোনো প্রস্তাব যেমন প্রতিনিধি পরিষদ আটকে দিতে পারে, তেমনটি কংগ্রেসের পাস করা প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে আটকে দিতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ৬ নভেম্বরের নির্বাচনে নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান পার্টি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখেছে ২৪২টি আসন জিতে (২০০৮ সালে ছিল ২৪৫)। আর সিনেটে ১০০ আসনের মধ্যে ডেমোক্র্যাটঘেঁষা ২ জনসহ ডেমোক্র্যাটদের ভোট হবে ৫৪ এমনকি ৫৫ (২০০৮ সালের নির্বাচনে ছিল ৫১টি আসন)। উল্লেখ্য, উচ্চকক্ষ সিনেটে বিজয়ী দল ডেমোক্র্যাটরা যদি ৬০টি আসন দখল করতে পারতেন, তাহলে রিপাবলিকানরা ফিলিবাটার বা দীর্ঘসূত্রতামূলক বক্তৃতায় দিনের পর দিন অনির্দিষ্টকালের জন্য যে কোনো প্রস্তাব আটকে রাখার অধিকারবঞ্চিত হতেন। তেমনটি হয়নি অবশ্য। ওবামা কেন এবং কীভাবে জয়ী হলেন, তা এখন দেখা যাক।
ঐতিহ্যগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উদারমতঘেঁষা রাজ্যের জনগণ মধ্য ও প্রগতিপন্থি ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ভোট দিয়ে থাকেন। আবার দক্ষিণ ও মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের রক্ষণশীলরা রিপাবলিকান প্রার্থীদের ভোট দিয়ে থাকেন। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে সর্ববৃহৎ অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়াতে (৫৫ ইলেক্টোরাল ভোট) বিজয়ী হয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা। ২০১২ সালের নির্বাচনেও সেই ধারা দুটি বজায় থেকেছে। ফলে জয়-পরাজয় নির্ণীত হয় ব্যাটেল গ্রাউন্ড রাজ্যগুলো_ ওহাইও, কলোরাডো, উইসকনসিন, ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলাইনা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ভার্জিনিয়া, আইওয়া ও নেভাডা এবং আশ্চর্যজনকভাবে সচরাচর ডেমোক্র্যাট পেনসিলভানিয়ার ভোটারদের মর্জি দ্বারা। একমাত্র নর্থ ক্যারোলাইনা বাদে অন্য সব দোদুল্যমান রাজ্যে ওবামা জয়ী হয়েছেন। ওবামার মিশিগান জয়ের পর নিশ্চিত হয়ে যায় যে, তার জয় অবশ্যম্ভাবী। কারণ মোটরযান শিল্পে ওবামার উদ্ভাবনী উদ্ধার প্ল্যানের বিরুদ্ধে রমনির তীব্র আক্রমণ অগ্রাহ্য করে যখন মিশিগান ওবামা শিবিরে ভোট দেয়, তখন ওহাইও এবং কলোরাডোরও একই পথে হাঁটার কথা। কারণ উদ্ধার প্ল্যান কার্যকরভাবে সুফল দেওয়া শুরু করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের চমৎকার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ধারায় মিট রমনি পরাজয় স্বীকার করে বারাক ওবামাকে অভিনন্দন জানান। তবে এতে ঘণ্টাখানেক বিলম্ব করেন তিনি। কারণ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রমনি কলোরাডো ও আইওয়াতে জয়ের আশায় ছিলেন।
ওবামা ও রমনিকে কারা সমর্থন করেছেন, সে তথ্যে দেখা যায়, এবারের নির্বাচনে মহিলা (শতকরা ৫৩ ভাগ) ভোটারের ৫৫ শতাংশ, ১৮-৪৪ বছরের লোকজন এবং আফ্রিকান-আমেরিকান, হিসপ্যানিক ও এশিয়ান ভোটারদের জোর সমর্থনেই ওবামা জয়ী হয়েছেন। প্রতি চার বছরে অভিবাসী ভোটারদের অনুপাত বাড়ছে শতকরা ০২ ভাগ করে (এবার ছিল শতকরা ২৫ ভাগ) এবং সে ভোটের সিংহভাগ ডেমোক্র্যাটরা পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ ওবামাসহ ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের সুবিধার ক্ষেত্রে অভিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ, বহুজাতিক ও নারী ভোটারদের সংখ্যাভিত্তিক অনুপাত বাড়তির দিকে।
ভোট ফেরত ও ভোট-পূর্ব জরিপে একটি কথা পরিষ্কার হয়ে আসে, ২০১২ সালের নির্বাচনে ভোটদানকারীদের কাছে অর্থনীতির হালচাল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল (শতকরা ৬০ ভাগ)। তাহলে মিট রমনির তীব্র সমালোচনায় দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দোষে দায়ী ওবামা কেন জয়মাল্যে ভূষিত হলেন! এর মূল কারণ, ডেমোক্র্যাটদের প্রচার ও সচেতন ভোটাররা স্মরণে রেখেছেন যে, ২০০৮ সালে ওবামা যখন প্রথম নির্বাচিত হন, তখন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ছিল শতকরা ১০.৭ ভাগ; প্রতি মাসে চাকরি হারাতেন কয়েক লাখ লোক; মোটরযান, গৃহায়ন ও ব্যাংক-বীমা ব্যবসায় চলছিল চরম মন্দা। এসব হতাশাব্যঞ্জক অবস্থার জন্য বিশ্বমন্দা ছাড়াও জর্জ বুশের ২০০০-০৮-এর শাসনামলের যুদ্ধবাজ নীতি ও প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, বিত্তবান তোষণে উচ্চ আয়ের করহার হ্রাসের অভিপ্রায়, সামাজিক সুরক্ষা খাতের খরচ কমিয়ে বাজেট ঘাটতি হ্রাসের নীতি-কৌশলকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিন জনগণ দায়ী করে। ওবামা বেশ দক্ষতার সঙ্গে মিট রমনির আগামী চার বছরের প্রস্তাবিত অর্থনীতিকে বুশের হতাশাব্যঞ্জক অর্থনীতির পুনরাবৃত্তি বলে ভোটারদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন। তা ছাড়া ২০০০ সালের ১০ দশমিক ৮ শতাংশের তুলনায় নির্বাচনের তিন দিন আগে প্রকাশিত শতকরা ৭ দশমিক ৯ ভাগ বেকারত্ব, প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৭১ হাজার জনের নতুন চাকরিতে যোগদান, ওহাইও, মিশিগান ও কলোরাডোতে ওবামার মোটরযান পুনর্জাগরণের দৃশ্যমান সুফল, জাতীয় আয়ে প্রবৃদ্ধি শুরু হওয়ার পূর্বাভাস, শিক্ষা/প্রশিক্ষণে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি তথা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, স্যান্ডির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত নিউজার্সি, নিউইয়র্কের দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সৎ সাহস এবং ওবামা কেয়ারে স্বাস্থ্য খাতসহ সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে ওবামার জন্য। অবিশ্বাস্যভাবে এবারের দীর্ঘ নির্বাচনী প্রচারে খুব বেশি সর্বনাশা ভুলচুক হয়নি।
প্রথম বিতর্কে ওবামার অতিবিনয়ী প্রায় পিছু হটা দিকটাই তার একমাত্র বড় ভ্রান্তি ছিল। পক্ষান্তরে রমনির প্রথম বিতর্কে স্পষ্টভাবে বিজয় এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিতর্কে সমানে সমানে লড়াকু প্রদর্শন তাকে 'জিতে যেতে পারেন' অবস্থানে রেখেছে সারাক্ষণ। রমনির জন্য সবচেয়ে বড় দায়ভার ছিল বিত্তবানদের অতিরিক্ত কর সুবিধা দানকারী, প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, ইরানে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার ইমেজ, সামাজিক খাতের ব্যয় হ্রাস এবং চার বছরে ১২০ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রস্তাবে অসঙ্গতি। আর মধ্যবিত্তের সমৃদ্ধির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জয়যাত্রার যে বাণী ওবামা শুনিয়েছেন, তা বিশ্বাস করেছে অনেক বেশি ভোটার। চীনের বিরুদ্ধে উভয় প্রার্থী সোচ্চার থাকলেও ওবামার ভাষ্য ও আচরণ অনেক মার্জিত ছিল। চীনকে 'কারেন্সি ম্যানিপুলেটর' বলে রমনি নিজের ক্ষতি করেছেন। চরম রক্ষণশীল কংগ্রেসম্যান পল রায়ান অত্যন্ত স্মার্ট, সুবক্তা এবং চমৎকার বিতার্কিক হলেও তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে সহযাত্রী করে অনেক মধ্যম পথে চলা ভোটারকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন রমনি। মিট রমনির একটি বিরাট ক্ষতির কারণ হয়েছে সিনেটে নির্বাচন প্রার্থী মারডকের সেই উচ্চারণ_ যার মাধ্যমে তিনি সব গর্ভপাতের বিরোধিতা করেছেন এই বলে, 'জবরদস্তিমূলক/ধর্ষণজনিত গর্ভ বিধাতার ইচ্ছায়ই হয়ে থাকে।' এই চরম মতবাদ থেকে রমনির দূরত্ব সৃষ্টি করা উচিত ছিল; ব্যর্থতার ফলে ইতিমধ্যে ওবামাপন্থি নারী ভোটারদের পাল্লা আরও ভারী হয়েছে। অবৈধ অভিবাসী শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগে বাধ্য করা হবে না_ ওবামার এই উক্তি অত্যন্ত ইতিবাচক হয়েছে, যেমনটি হয়েছে বিল ক্লিনটনের গলা ফাটানো সমর্থন। প্রচারে তার দৃষ্টিভঙ্গি লুকিয়ে রাখতে পারলেও অভ্যন্তরীণ সভায় প্রদত্ত 'শতকরা ৪৭ ভাগ লোক পরগাছা, সরকারি সম্পদে লালিত এবং ওবামা সমর্থক। এদের প্রতি আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই' বক্তব্যটি জনসমক্ষে আসায় রমনি মার্কিন সমাজকে ভাগ করে ফেলার দায়ে পড়েন।
ওবামার বিজয় ও রমনির পরাজয়কে পাকিস্তান ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ চরম দক্ষিণপন্থিরা ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্রই স্বাগত জানিয়েছে। দ্বিতীয় বিতর্কে ইসরায়েলকে আক্রমণ করলে ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে_ বক্তব্য দিয়ে ওবামা মধ্য ও উদারপন্থি লিবারেল পার্টিসহ অন্য সবাইকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে আশ্বস্ত করেছেন। তবে ইরানের পরমাণু বোমা রোধ, সিরিয়ার বিস্ফোরিত পরিস্থিতি ও ন্যায়সঙ্গত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, একদা বিশ্বস্ত মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের চরমতম অবনতি, ওই দেশের অর্থনীতিতে বিপুল ধস এবং উদীয়মান পরাশক্তি গণচীনের সঙ্গে সহাবস্থান বিষয়ে ওবামার নীতি-কৌশল সারাবিশ্বের সতর্ক দৃষ্টিজালে আবদ্ধ থাকবে।
অভ্যন্তরীণ নীতি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ওবামার কঠিন পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ১ জানুয়ারি বুশের চালু করা হ্রাসকৃত করহারের মেয়াদ শেষ হবে। বাড়বে প্রায় সব মার্কিনির করের বোঝা। ব্যক্তি খাতে কমবে খরচ ও বিনিয়োগের ক্ষমতা, যা বাজারভিত্তিক অর্থনীতির জীবনীশক্তি। কাটছাঁটের মুখে পড়বে ১২ হাজার কোটি ডলারের মার্কিন বাজেট, যদি না কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করা যায়। তার জন্য প্রয়োজন কংগ্রেসের সহযোগিতা, যেটি ওবামা আদায় করতে পারেননি দু'বছর আগে তার প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান পরিকল্পনায়। এই কঠিন পরীক্ষার বাস্তবতায় আশার আলো বিজয় ভাষণে ওবামার নমনীয়তা এবং প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার প্রভাবশালী রিপাবলিকান নেতা বুয়হেনার 'প্রেসিডেন্ট এগিয়ে এলে আমরাও সহযোগিতার হাত বাড়াব' বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে ফিসক্যাল ক্লিফের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রের জোরদার জয়যাত্রায় সারাবিশ্ব শামিল ও উপকৃত হতে পারে বলে আশার সঞ্চার হয়েছে বৈকি। তবে প্রেসিডেন্ট ওবামাকেই তার জনকল্যাণমুখী এবং মজবুত মধ্যবিত্ত শক্তি গঠন করে বিশ্বের সব মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় থেকে বিচ্যুত না হয়েও রক্ষণশীল হলেও রিপাবলিকান নেতৃত্বের ইতিবাচক অংশের সঙ্গে সমঝোতার পথে আগ বাড়িয়ে সমাধান বের করতে তৎপর হতে হবে। নির্বাচনী প্রচারে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও এর কুপ্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে তার উপলব্ধি এবং যে কারণে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী মেয়র ব্লুমসবার্গের (আগে রিপাবলিকান বর্তমানে ইন্ডিপেনডেন্ট) প্রকাশ্য সমর্থন তিনি পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে সে ব্যাপারে উষ্ণতা সৃষ্টিকারীর দায় মেনে নিয়ে সবাই মিলে সবার স্বার্থে এর সমাধানে অগ্রণী হতে হবে। তা ছাড়া বিশ্বের নানা দেশ থেকে নানা বর্ণ, জাতি, ধর্ম ও পেশার মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন ভাগ্য উন্নয়নের অন্বেষায়। তাদের পাশে অব্যাহত সহমর্মিতায় ওবামাকে দাঁড়াতে হবে। বলাবাহুল্য, বর্ষীয়ান ও পাকা বিচার-বুদ্ধির অধিকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশ্যই প্রেসিডেন্টের জন্য একজন সুপরামর্শদাতা সম্পদ।
ওবামার পুনর্নির্বাচনের ফলে অন্যান্য গণতন্ত্রকামী দেশের মতোই মডারেট গণতন্ত্র (মডারেট ইসলামী দেশ নয়) বাংলাদেশে নানা সুবর্ণ সুযোগের সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক মিত্র বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, গণতন্ত্রের প্রতি জনগণ ও সরকারের নিষ্ঠা, আস্থা; জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এবং জনকল্যাণে নিবেদিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ধারায় ওবামা পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ও অব্যাহত সমর্থন পাওয়া ভবিষ্যতে আরও সহজ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কূটনীতি ও অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অনেক বেশি দক্ষ এবং শক্তিশালী হতে হবে। ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রশাসনে ২০১৬ সালে ডেমোক্রেটিক টিকিটে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন সেক্রেটারি অব স্টেট থাকবেন না বলেই অনুমান। বাংলাদেশের এখন অবশ্য কর্তব্য হবে, দু'তিনটি বিষয়ে যে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যাসহ আলাপ-আলোচনা করা। এর একটি হতে পারে গ্রামীণ ব্যাংকের আইনি পজিশন; গ্রামীণফোনের দেশীয় মূলধন অংশের লভ্যাংশ কোথায় কীভাবে বিতরণ করা হচ্ছে; এ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের ইকুইটি হোল্ডার মহিলারা কতটুকু উপকার পাচ্ছেন; যে কোনো যুক্তি, ন্যায় ও আইনসিদ্ধ সমঝোতামূলক সমাধানে সরকারের প্রস্তুত থাকার বিষয়গুলো সম্পর্কে মুিন্সয়ানামূলক বক্তব্য উপস্থাপনা ইত্যাদি। আর একটি বিষয় হতে পারে, গলদপূর্ণ পদ্ধতির মাধ্যমে কেবল ধারণার বশবর্তী সূচকে বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিতকারীরা দেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করলে দেশের সীমা-অতিরিক্ত ক্ষতি। জঙ্গি ও মৌলবাদ দমন তথা জঙ্গি দমনে গণতন্ত্রকামী জনগণ ও সরকারের অব্যাহত কৃতসংকল্পতার কথাও জানাতে হবে।
সবকিছু মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের সহজাত সখ্য অনেক বেশি শক্তিশালী হতে পারে।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক

No comments

Powered by Blogger.