রোহিঙ্গা- সমস্যাটি শুধু মিয়ানমারের নয়, আমাদেরও by আলী ইমাম মজুমদার

শিরোনাম দেখলেই পাঠক অনুমান করতে পারবেন রোহিঙ্গা সমস্যাটি আলোচনায় আসছে। সমস্যাটির সূচনা প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে। তবে সেখানেই এর প্রভাব সীমাবদ্ধ নেই। যথেষ্ট পরিমাণ ভোগান্তিতে আমাদের থাকতে হয়, হচ্ছে। এটা আমাদের একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করছে দীর্ঘদিন ধরে।


তাই এর স্থায়ী সমাধানের জন্য আমাদের সক্রিয় উদ্যোগ আজ সময়ের দাবি। সমস্যাটি আদৌ ক্ষুদ্র নয়। আমরা এখনই সক্রিয় না হলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের খেসারত দিতে হতে পারে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, আরাকান প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অব্যাহতভাবে অপর একটি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চলছে আর এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তাদের দেশত্যাগের চেষ্টা বিষয়টিকে আমাদের সামনে নতুনভাবে নিয়ে এসেছে।
আগেও কয়েক দফায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের আশ্রয় দিতে হয়েছে হাজার হাজার শরণার্থীকে। ১৯৭৮ সালে আসে প্রায় তিন লাখ। অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সেসব শরণার্থীর সফল প্রত্যাবাসন করা হয়। ঠিক প্রায় সে অনুরূপ সংখ্যায় শরণার্থী আসে ১৯৯২ সালে। তাদের অর্ধলক্ষাধিককে (এ দেশে জন্ম নেওয়া বংশধরসহ) আজও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। তদুপরি শরণার্থী স্বীকৃতি না নিয়েই বিভিন্ন সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। তাদের কেউ কেউ এ দেশের পাসপোর্ট নিয়ে পাড়ি দিয়েছে বিদেশে, যার সিংহভাগ সৌদি আরবে। আরাকানের সাম্প্রতিক ঘটনায় রোহিঙ্গারা বৃহৎ সংখ্যায়ই এখন চলে আসতে উদগ্রীব বলে জানা যায়। বিভিন্ন জলযানে নাফ নদীতে বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা সে প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালাচ্ছে বলে সংবাদপত্রে খবর এসেছে।
রোহিঙ্গাদের এ দেশে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করতে দিতে সরকার দৃঢ়ভাবে অসম্মতি জানাচ্ছে। সেটা বাস্তবায়ন করছে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন। জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার জন্য অনুরোধ রাখছে। সরকার সে অনুরোধ রক্ষায় সম্মত হয়নি। জনবহুল একটি দেশে এ বাড়তি জনসংখ্যার চাপ আমাদের জন্য সত্যিই কঠিন। তদুপরি স্থানীয় জনমত, আইনশৃঙ্খলা, চলে আসা শরণার্থীদের দেশে ফেরত যেতে অনীহা, মিয়ানমার সরকারেরও একই ধরনের নীতি ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে যথাযথ বলেই মনে হয়। তবে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাণভয়ে আশ্রয়হীন পলায়মান রোহিঙ্গাদের এ দেশে ঢুকতে না দিলেই সমস্যাটি শেষ হয়ে যাবে না। এটাকে স্থায়ী সমাধানের দিকে নিতে নিজেদের স্বার্থে আমাদের পক্ষ থেকে জোরালো প্রচেষ্টা দরকার।
প্রথমেই আলোচনায় আসে, এরা কারা? এদের নৃতাত্ত্বিক দিক সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে জোরালো মতামত হচ্ছে, সহস্রাধিক বছর ধরে তারা আরাকানের অধিবাসী। মিয়ানমার সরকার অবশ্য বলছে, ১৯৫০ সালের দিকে তারা চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। তবে এ দাবির পক্ষে তথ্য আমরা দেখি না। এরা সংখ্যায় প্রায় ১৪ লাখ আর ধর্মে সবাই মুসলমান। এ ১৪ লাখের মধ্যে আরাকানে আট লাখ, বাংলাদেশে তিন লাখ, পাকিস্তানে দুই লাখ, থাইল্যান্ডে এক লাখ এবং মালয়েশিয়ায় ২০ হাজারের মতো বর্তমানে বসবাসরত আছে বলে জাতিসংঘের একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়। অথচ তারা সবাই ছিল আরাকানের অধিবাসী। বিভিন্ন সময়ে একই কারণে দেশান্তরী হয়েছে। তবে এটা ঠিক ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি দিক দিয়ে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকজনের কাছাকাছি। তেমনিভাবে আরাকানের ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকটা মিল আছে এমন নাগরিক আমাদের দেশেও আছে। তাদের আমরা কখনোই ভিনদেশি ভাবি না। পড়শির ভাষা ও সংস্কৃতি কাছাকাছি হওয়াই স্বাভাবিক। যেমনটা আমাদের সঙ্গে মিল আছে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের (বাঙালি, অবাঙালি-নির্বিশেষে) জনগণের। মিয়ানমার ১৯৮২ সালে নতুন নাগরিকত্ব আইন করে রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে দীর্ঘকালের অধিকার কেড়ে নেয়। জাতিগত হানাহানি আরাকানে প্রায়ই ঘটছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসন এ দুর্বল জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না।
কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থানীয় জনমত রোহিঙ্গাদের এ দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে নয়। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। এদের একটি অংশ শ্রমবাজারে ঢুকে পড়ে স্থানীয় লোকদের কর্মসংস্থানে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ বিশেষত, জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। বনজঙ্গল উজাড় করার অভিযোগ তো আছেই। তবে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে, সেখানকার স্থানীয় ধনিক শ্রেণীর একটি অংশের পৃষ্ঠপোষকতাতেই রোহিঙ্গারা তুলনামূলক কম বেতনে নিয়োগ পায় মাছ ধরার বোট, চিংড়িঘের, ইটভাটাসহ শ্রমঘন কাজে। বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে কারও কারও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও অনেকাংশে সত্য। তবে ঢালাওভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে অপরাধী বলা যাবে না।
এই নিবন্ধকারের দুই দফায় রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির ব্যবস্থাপনাসহ সমস্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। প্রথমবার ১৯৭৯ সালে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে আট মাস সরাসরি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আর দ্বিতীয়বার ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল প্রায় তিন বছর জেলা প্রশাসক হিসেবে প্রধানত তদারকি ও আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এদের একটি অংশ অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হওয়ার পেছনে কাজ করছে রাষ্ট্রবিহীন, সবার সহানুভূতিবঞ্চিত ও উপেক্ষার পাত্র এ মানুষগুলোর নিজ দেশে নির্যাতন ভোগ করে পরবাসী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করা। প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকছে তারা। তাদের এ হতাশ মানসিকতার সুযোগটি নিচ্ছে শক্তিশালী অপরাধী ও জঙ্গিচক্র। তারা নিজ ভূমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারলে অনেকে অপরাধের ধারেকাছেও ভিড়ত না, এটা জোর দিয়ে বলা যায়। আর ইচ্ছা করে কেউ নিজের ভিটামাটি ছেড়ে মানবেতর জীবনের পথ বেছে নেয় না। অনেক সজ্জন ব্যক্তি আছে তাদের সমাজে। আর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে ধরনের অপরাধের অভিযোগ আছে, সে ধরনের অপরাধে আমাদের সমাজের কিছু লোকও পিছিয়ে নেই।
এখন আরাকানে রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার। আমরা ঢুকতে দিচ্ছি না। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর চক্ষু এড়িয়ে প্রায়ই কিছু ঢুকে পড়ছে না এমন দাবি কি করা যাবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রেও তো সীমান্ত পেরিয়ে বেআইনিভাবে কিছু লোক প্রতিনিয়ত ঢুকে পড়ছে। আমাদের এটাও বিবেচনায় রাখা দরকার, রোহিঙ্গাদের এপারে অনেক স্বজন রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের নাগরিক। তারা কি রোহিঙ্গাদের বর্তমান বেহাল অবস্থায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ হচ্ছে না? আর সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে আমাদের সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির ওপর। অতিসমপ্রতি কক্সবাজারে যে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে গেল, সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের জনশ্রুতি রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা অসমর্থনযোগ্য এবং শনাক্ত হলে আইনের আওতায় নেওয়া উচিত। তবে এর পুনরাবৃত্তি রোধে জোরালো প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি বারুদের স্তূপ যাতে না জমতে পারে, তার জন্য সবারই সচেষ্ট হওয়ার আবশ্যক।
মিয়ানমার দীর্ঘকাল ভিন্ন একটি অধ্যায় কাটিয়ে আজ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে। এতে বিশাল অবদান রেখেছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির দীর্ঘকালের ত্যাগ ও সংগ্রাম। কিন্তু আমরা ব্যথিত হই তাঁর মতো নেতাও সমস্যাটির ব্যাপারে নীরব। বলা হয়, রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তিনি নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা তাঁর অবস্থান হবে রাষ্ট্রনায়কোচিত (Statesman)। গণতন্ত্রের ধারণাটি তো আসে মানবাধিকার থেকে। এ নৃগোষ্ঠী যত ক্ষুদ্র হোক, নিজ ভূমে তাদের জীবনধারণ ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকারের স্বীকৃতি তাঁকে আরও মহীয়সী করবে। অবশ্য তিনি বিরোধী দলের নেতা। তবে হালে অসাধারণ তাঁর প্রভাব দেশে ও সারা বিশ্বে। মিয়ানমারের বর্তমান শাসকদেরও বাস্তবতাটি উপলব্ধি করা দরকার। অবশ্য বিষয়টি তাঁরা ভাবছেন বলে অতিসমপ্রতি একটি খবর এসেছে। গণতন্ত্রের পথে যাত্রালগ্নে পশ্চিমা বিশ্ব সব নৈতিক ও বৈষয়িক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে মিয়ানমারের প্রতি। জাতিসংঘ এবং সে দেশগুলো তো রোহিঙ্গা সমস্যার মানবিক দিকটি জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারে মিয়ানমারের কাছে।
সমস্যাটি আমাদের নয়, মিয়ানমারের—এটা বলে আমরা নিশ্চিত হয়ে বসে থাকতে পারি না। যে সমস্যা আমাদের প্রভাবিত করছে, তা সমাধানের জন্যও আমাদের জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দরকার। মিয়ানমারসহ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছে অব্যাহতভাবে আমরা এ মানবিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি জানিয়ে যেতে পারি। সে রকম কোনো প্রচেষ্টা কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে না।
আমাদের দেশে মানবাধিকার নিয়ে যে সংগঠনগুলো কাজ করে, এ বিষয়ে তারা ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছে। তবে তারা তাদের সহযোগী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বিষয়টির দিকে নজর দিতে পুনঃ পুনঃ দাবি জানাতে পারে। বারবার দাবি জানাতে পারে আমাদের সরকারের জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নেওয়ার জন্য। অসামপ্রদায়িক শক্তিগুলোকেই এখানে অগ্রণী ভূমিকায় আসা দরকার। কেননা, সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসামপ্রদায়িক চেতনায় জোরদার করতে পারলেই আমরা অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্রের ভিতকে জোরদার করতে পারব। সামপ্রদায়িক শক্তির তখন বিষয়টি নিয়ে পুঁজি করার সুযোগ কমে যাবে। বলাবাহুল্য, শুধু রাষ্ট্রশক্তির প্রচেষ্টাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। আর এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়কে ক্ষুদ্র বলে উপেক্ষা করলে পরিণতি অনেক সময়ই ভালো হয় না। ধর্মীয় বা যেকোনো ধরনের সামপ্রদায়িকতা আমাদের দেশে যেমন নিন্দনীয় ও বর্জনীয়, তেমনি অন্যত্র ঘটলেও তা নিন্দনীয় বটে। আর তা বর্জন করার দাবি তোলাও নৈতিক কারণেই যথার্থ। সে দাবি ক্ষীণকণ্ঠের হবে না, হতে হবে সংযমী কিন্তু জোরালো।
 আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

No comments

Powered by Blogger.