নববর্ষ-লোকঐতিহ্যের ধারকবাহক হলেই কল্যাণ by এম শমশের আলী

পহেলা বৈশাখ মূলত ছিল কৃষি ও কৃষিজীবী মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশের লোকঐতিহ্যের ধারক ও বাহক যারা, পহেলা বৈশাখে তাদের অংশগ্রহণ ও তাদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারাই হোক পহেলা বৈশাখের আসল বৈশিষ্ট্য পহেলা বৈশাখ যদি 'মানুষ' হতো তবে তাকে বলতাম_ 'হে পহেলা বৈশাখ, তোমাকে আমরা গণমানুষের জীবন থেকে হাইজ্যাক করেছি।'


আকবর বাদশাহ যখন ফসলি সন হিসেবে বৈশাখকে বাংলা নববর্ষের ঘোষণা দিলেন, তারিখটি ছিল ইংরেজি ১৫৮৪ সালের ১০ মার্চ। তখন বঙ্গে পহেলা বৈশাখ ঠিক কীভাবে পালন করা হতো তার কিছুটা জানা যায় বইপুস্তক থেকে। তবে আমাদের সময়ে বা আমাদের চেয়ে বয়সে একটু বড়, তাদের ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখ কীভাবে পালন করা হতো, তা অনেকেরই মনে আছে। এখন যেভাবে পহেলা বৈশাখ পালন করি তা একটা ঃুঢ়ব-এ পরিণত হয়েছে। গণমানুষের পহেলা বৈশাখ পালন উৎসব থেকে তা বেশ কিছুটা ভিন্ন। এই ঃুঢ়ব-টা কী করে এলো তারও একটা ইতিহাস আছে। মূলত ১৯৬৫ সাল থেকে সেটার শুরু। সেই সময় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর নিষেধজ্ঞা জারি করে। এর চেয়ে বড় মূর্খতা আর কী হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ যে শুধু বাঙালির সম্পদ নন, তিনি যে বিশ্বসম্পদ এবং তার কথায় ও গানে যে একটা সর্বজনীন আবেদন রয়েছে এবং সব মানুষের হৃদয়ের কথা তার গানের মধ্যে অনুরণিত হয়েছে_ সে কথা না বুঝে পাকিস্তান সরকার ভুল করল। এ ভুল তারা একবার নয়, একাধিকবার করেছে। বাংলা ভাষাকে বহুদিন পর্যন্ত এ দেশের মানুষের মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া, ১৯৫২ সালে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর গুলি চালানো, ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা, একাত্তর সালে এ দেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর গুলি চালানো_ এ রকম মানবতাবিরোধী অন্যায়ের লম্বা ফিরিস্তি আছে। থাক, ১৯৬৫ সালে ফিরে আসি। রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়াকে নিরুৎসাহিত করার সরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধে এ দেশের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ গর্জে ওঠে। প্রসঙ্গত, এ ক্ষেত্রে আমাদের ছায়ানটের ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাঙালি সংস্কৃতিচর্চায় নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ছায়ানট রমনা পার্কে প্রভাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে। এর পর থেকেই শুরু হয় নিয়মিতভাবে রমনার বটমূলে জড়ো হওয়া, গান শোনা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া, পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়, নববর্ষের আগমনবার্তা জানিয়ে (যদিও ক'দিন পরেই, বাংলা সন-তারিখ বলতে বললে অনেকেই বিপদ গোনেন)। যে ঃুঢ়ব-এর কথা বলছি এটাই সেই ঃুঢ়ব। সঙ্গীত এ দেশের মানুষের কাছে অতি প্রিয়, সব ধরনের সঙ্গীত_ রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, লালনগীতি, লোকসঙ্গীত, ধ্রুপদী সঙ্গীত ইত্যাদি। এসব সঙ্গীত মানুষ প্রতিনিয়তই শুনতে চায়_ মৌসুমে তো বটেই। ছায়ানটকে সাধুবাদ জানাই এ দেশের মানুষের প্রিয় গানগুলোকে তাদের সামনে পরিবেশনের জন্য। কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানুষ দিনযাপন আর প্রাণধারণের গল্গানিকে ভুলতে পারে। একি কম পাওয়া! কিন্তু এসব সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখের আসল আনন্দ কি আসে গণমানুষের জীবনে? উৎসব ঢাকায় হয়, সে রকমটা হয় অন্যান্য শহরে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলো এগুলোই তুলে ধরে আমাদের জাতীয় উৎসব হিসেবে। গ্রামে-গঞ্জে মানুষ কী করে, কী খায়, সেখানকার উৎসব কীভাবে ঘটে, তার খবর আমরা ক'জনইবা রাখি। চ্যানেল আইয়ের শাইখ সিরাজ বেশ কিছুদিন কৃষিকর্মের পাশাপাশি এসব খেটে খাওয়া মানুষের উৎসবের কথা তুলে ধরছেন চ্যানেল আইয়ে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে গ্রামবাংলায় উৎসবের আয়োজন করা ছাড়াও হঠাৎ করে গিয়ে মানুষ সেখানে কী করছে, কী খাচ্ছে, কী গাইছে, সেটা ক্যামেরাবন্দি করে জাতির সামনে তুলে ধরলে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে গ্রাম বাংলার চিত্রটি আরও ভালো করে ফুঠে উঠত। ওরা ওদের ৎড়ড়ঃং বা শিকড়টা কোথায় তা কিছুটা অন্তত বুঝতে পারত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, জীবনে জীবন যোগ করা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা। জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোতে থাকে জীবনে জীবন যোগ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ। সে সুযোগ আমরা হারাই কেন? ভাবতে অবাক লাগে, পহেলা বৈশাখের আসল তাৎপর্য ভুলে গিয়ে, আমরা শহরবাসী গ্রামের মানুষের রোজনামচাকে যে কতভাবে উপহাস করে চলেছি তার ইয়ত্তা নেই। গ্রামবাংলার মানুষ প্রতি সকালেই পান্তা ভাত খায়, নুন পেঁয়াজ মরিচ আর যে তরকারি জোটে তা দিয়েই (এখন ইলিশ মাছ তাদের ভাগ্যে কালে-ভদ্রেও জোটে কি-না সন্দেহ) তারা খায়। অথচ বিত্তবান শহরবাসী পহেলা বৈশাখে চড়া দামে ইলিশ কিনে পান্তা-ইলিশ খেয়ে দেশীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হওয়ার চেষ্টা করছে_ সেটা কি গ্রামের মানুষকে উপহাস করার শামিল নয়?
পহেলা বৈশাখের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য 'হালখাতা'। অর্থাৎ নতুন হিসাবের বই খোলা। এটি ছিল একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। দোকানিরা বাকিতে জিনিস দিত। খদ্দেররা বছরের পহেলা বৈশাখের দিনে আসত, বকেয়া পরিপূর্ণভাবে পরিশোধ করত অথবা সাধ্যমতো দিয়ে আবার নাম ওঠাত নতুন খাতায়। তবে টাকা পরিশোধ করার পদ্ধতিটা ছিল আনন্দের। প্রত্যেক ব্যবসায়ীর দোকানে বা বাসায় খাবার খেত আনন্দের সঙ্গে। হালখাতার কথা বললেই অনেক পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায় আমার। প্রায় ষাট বছর আগে যশোরে থাকাকালীন আমি আমার ভাইদের সঙ্গে যশোরের মনোহর বস্ত্রালয়ে (দোকানটা এখনও আছে কি-না জানি না) হালখাতা খেতে যেতাম। হ্যাঁ, হালখাতার হিসাবের চেয়ে খাওয়াটাই বড় ছিল। সে কী খাওয়া_ ঘিয়ে ভাজা লুচি, আলুর দম, সন্দেশ ইত্যাদি। শুধু ওখানেই খাওয়া নয়_ আসার সময় একটা পোঁটলাও বেঁধে দিত যারা আসেনি তাদের জন্য। এখন দিনকাল অন্যরকম। বাকিতে জিনিস কেনা হয় না। হালখাতার দাওয়াত পাই না। তবে কিছু স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ী কার্ড পাঠান। তাতে সামাজিকতার আমেজ কিছুটা থাকে কিন্তু পুরোপুরি হালখাতার আমেজ থাকে না। গ্রামে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আমেজ ছিল আলাদা। যতটা না থাকত বাইরের চাকচিক্য, এর চেয়ে বেশি থাকত মনের আনন্দ। সকাল হতে না হতেই গ্রামের লোক স্নান সেরে সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে আসত। পান্তা রোজকার খাবার বিধায় ওইদিন সব ভালো খাবার, পিঠা-পুলি দিয়ে আত্মীয়-স্বজনকে আপ্যায়ন করা হতো।
অল্পেতে তুষ্ট ছিল মানুষ। আকর্ষণীয় কৃষিপণ্য থাকত মেলায়। গ্রামবাসী তাকিয়ে থাকত এই বৈশাখী মেলার জন্য। নানা রকমের মজার মজার জিনিস পাওয়া যেত মেলায়। সেই পুরনো বায়োস্কোপ দেখা। খাবার থাকত নানা রকম_ খাজা, গজা, কদমা, বাতাসা, মুড়কি, নানা আকৃতির ছাঁচের মিষ্টি। থাকত মাটির নানা নকশার পুতুল, পাখি, পাত্র, বাঁশের বাঁশি, বেলুন, বেলুনি, তালপাতার পাখা (যা এখনও লোডশেডিংয়ের সময় কাজে লাগে)। গ্রামবাংলার বৈশাখী উৎসবের এক আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যাত্রা, কবিগান, জারিগান, লালনগীতি, গম্ভীরা গান, গাজীর গান ইত্যাদি। এগুলো আমাদের লোকঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ আর এগুলোর ধারক-বাহক গ্রামবাংলার লোকেরা। দুঃখ লাগে একথা ভেবে যে, আজকে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে পহেলা বৈশাখের মাধ্যমে এই ঐতিহ্য অনুসরণের মধ্যে যে আনন্দ ও গর্ব আছে, তার ভাগীদার করতে পারছি না। তাদের কেউ কেউ সকালবেলা প্রভাতফেরি করে সন্ধ্যায় ব্যান্ড মিউজিক বাজিয়ে এক অন্য সংস্কৃতির জন্ম দেয়। একি আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা নয়?
আমরা যারা পুরনো দিনে বৈশাখী উৎসব দেখেছি তাদের একটাই ভাবনা_ কবে আবার আমরা বাঙালি হবো মনে ও প্রাণে, কথায় ও কাজে, পোশাকে আর ভঙ্গিতে নয়।
পরিশেষে, পহেলা বৈশাখকে আমাদের জীবনে আরও অর্থবহ করার জন্য কয়েকটি সুপারিশ করছি। প্রথমত, আমরা আমাদের আর্থিক বছর পহেলা বৈশাখ থেকে ৩১শে চৈত্র পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারি। এটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। বিদেশের আর্থিক বছর জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত হলেও কোনো অসুবিধা নেই_ সেটাকে আমাদের আর্থিক বছরের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো বিপত্তি নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলা সনকে যেহেতু খাজনা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়েই চালু করা হয়েছিল, তাই ব্যবসায়ীদের উচিত তাদের এবং ক্রেতাদের মধ্যে প্রীতি ও সৌহার্দ্য স্থাপনার প্রতীক হিসেবেই পহেলা বৈশাখকে পরিগণিত করা। ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা লাভের প্রতি সাধারণ লোকের একটা বিরূপ মনোভাব বিরাজমান। পহেলা বৈশাখের উৎসবে ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে একটা ভালো সম্পর্ক শুধু তাদের জন্য নয়, দেশের জন্য মঙ্গলকর হবে। সবশেষে এ কথাটা বলতে চাই, একটা জাতীয় উৎসবে দেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভালো করে তুলে ধরা একান্তই জরুরি। এখনকার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মিডিয়া প্রক্ষেপণ অনেকটা 'এলিটিস্ট' ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পহেলা বৈশাখ মূলত ছিল কৃষি ও কৃষিজীবী মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশের লোকঐতিহ্যের ধারক ও বাহক যারা, পহেলা বৈশাখে তাদের অংশগ্রহণ ও তাদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারাই হোক পহেলা বৈশাখের আসল বৈশিষ্ট্য।

অধ্যাপক ড. এম শমশের আলী : প্রেসিডেন্ট
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী, প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি ও প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.