বৈশাখে সবুজ শুভেচ্ছা by শেখ রোকন

নববর্ষ উপলক্ষে একটি সেলফোন কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় আজ ধানমণ্ডি লেকে নৌকাবাইচের যে আয়োজন করা হয়েছে, বিশুদ্ধতাবাদীরা তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। বঙ্গের প্রাচীন এই আয়োজন নদীতেই হতে হয়; কারণ বিষয়টি কেবল দর্শনধারী নয়। নৌকাবাইচের গুণবিচারি দিক হচ্ছে, অনেকে নিশ্চয়ই জানেন, ছোট নদীর নাব্যতার ক্ষেত্রেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।


আমাদের পূর্বপুরুষরা যে কারণে নৌকাবাইচকে এত গুরুত্ব দিয়ে বার্ষিক আয়োজনে পরিণত করেছিল। কিন্তু এখন তো আর সে রাম নেই, অযোধ্যাও বদলে গেছে। নৌকাবাইচ ঢুকে পড়ছে বদ্ধ জলাশয়ে।
এই অঘটনের সঙ্গে কেউ যদি শুভেচ্ছা কার্ডের ডিজিটাল যাত্রাকে মেলাতে চান, দোষ দেওয়া যায় না। তবে গত তিন দশকে নাগরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের বাহন হিসেবে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী 'গ্রিটিংস কার্ড' যদিও এখনও পশ্চিমা বিশ্বের মতো লাপাত্তা হয়ে যায়নি; এর ডিজিটাল সংস্করণ ছড়িয়ে পড়েছে বহুগুণে। কেউ কাউকে নববর্ষ কিংবা অন্য কোনো উপলক্ষে ই-কার্ড পাঠালে এখন আর মুখরোচক সংবাদ তৈরি হয় না। যে কোনো উপলক্ষে ফেসবুক ওয়াল কিংবা ই-মেইলের ইনবক্স ভরে যায় শুভেচ্ছা কার্ডে। ঠিক আগের দিনে যেভাবে শুভেচ্ছা বার্তায় উপচে পড়ত লেটার বক্স। উৎসব উপলক্ষে ইলেকট্রনিক বার্তারও ঢল নামে। সেলফোনে রয়েছে সংক্ষিপ্ত বার্তার অবারিত সুযোগ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শ্রমজীবী মানুষের হাতে থাকা সেলফোন থেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের প্রতি এসএমএস পাঠানোর এক সর্ববিস্তারি সংস্কৃতি চালু হয়েছে। শিক্ষাগত সীমাবদ্ধতা, সামাজিক সংকোচ কিংবা সুলভ না হওয়ার কারণে আগে যে শ্রেণীর নাগরিকদের মধ্যে উপলক্ষে-উৎসবে শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের চল ছিল না, তারাও আজকাল, কপি করে হলেও, দিব্যি এসএমএস পাঠাচ্ছে। 'সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগী বহুজাতিক কোম্পানি এর মধ্য দিয়ে বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ শুষে নিচ্ছে'_ বঙ্গীয় বিপ্লবীরা এমন অভিযোগ না তুললে, শুভেচ্ছা বিনিময়ের নতুন ও বিস্তৃত এই প্রপঞ্চ মন্দ কি!
অবশ্য বিপ্লবীরাই শুধু নয়, বুর্জোয়ারাও শুভেচ্ছা বিনিময়ের বর্তমান কায়দা নিয়ে কখনও কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকেন। কারণ বন্ধু ও স্বজনদের পাশাপাশি নতুন পদ্ধতিতে অবাঞ্ছিত শুভেচ্ছাও কম আসে না। নববষের মতো উপলক্ষে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রমোশনাল ই-কার্ড ও বার্তা জঞ্জালের মতো এসে জড়ো হয় ব্যক্তিগত বক্সে। এ নিয়ে বিরক্তদের জন্য সান্ত্বনা হতে পারে_ বাণিজ্যিকীকরণের এই যুগে ই-কার্ড কিংবা বার্তা না থাকলেও লেটারবক্সে অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ ঠেকানো সহজ ছিল না। কাগজের চেয়ে ইলেকট্রনিক জঞ্জালই বরং সুবিধাজনক। আবর্জনার ঝুড়ি টানাটানির ঝামেলা নেই। যদিও খানিকটা দূরবর্তী, উল্টো সুবিধাও আছে।
কাগজের সংস্করণের তুলনায় ই-কার্ডে শুভেচ্ছা অনেক বেশি পরিবেশসম্মত বলে স্বীকৃত। বেশি কাগজ ব্যবহার মানেই তো বেশি গাছপালার জীবন করাতের নিচে বলি হওয়া। অর্থাৎ ভারতের জনপ্রিয় সেলফোন কোম্পানির ততোধিক জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনটির ঢঙে বলতে গেলে, নববর্ষে ই-কার্ডে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন মানে আপনি উদ্ভিদ রক্ষায় ভূমিকা রাখছেন। আর কে না জানে যে বঙ্গে বৈশাখ মানে আসলে বসন্তের পূর্ণতা। ফাল্গুন ও চৈত্র যদিও বসন্তকাল, তখন দিগন্ত রাঙানো কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া কিংবা জারুল বৈশাখের আগে গাঢ় হয়ে ওঠে না। বৈশাখেই যদি কাগুজে শুভেচ্ছার ছড়াছড়ি হয়, তাতে কৃষ্ণচূড়া ও জারুলের রঙই ম্লান হয়ে যায়। রঙিন শুভেচ্ছা কার্ড হয়তো ঘরের শোভা বর্ধন করে; কাগজের জন্ম দিতে গিয়ে হারিয়ে যায় প্রকৃত সবুজ।
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.