প্রতিশোধটা না হয় হয়েই যাক! by মোস্তফা মামুন

আয়ারল্যান্ড একবার আমাদের সঙ্গে একটা জঘন্য অন্যায় করেছিল। আরেকবার আমাদের সাফল্যযাত্রায় কালিমা লেপন করেছে। ঝামেলা করেছে আরো একবার; টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হারিয়ে বসেছিল বাংলাদেশকে। সব মিলিয়ে অপরাধ তো দেখছি তিনটি। বদলা নেওয়া খুব জরুরি। ও, হ্যাঁ। এক হিসাবে বদলা তো নেওয়া হয়ে গেছে।


ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশে এসেছিল, তাতে বাংলাদেশ ৩ আয়ারল্যান্ড ০। অঙ্কের হিসাবে প্রতিশোধ হয়েছে কিন্তু মনের যে হিসাব তা তো মেটেনি। অহংয়ে যে আঘাত সেটা যে আজও দগদগে ঘা। শুকিয়ে যাবে। মনের অঙ্কও মিলবে। এ জন্য ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে। আজ আয়ারল্যান্ডকে হারানো।
জঘন্য অন্যায়টার কথা বলি শুরুতে। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে। সেবার আইসিসি ট্রফি বাংলাদেশ না জিতলে আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট এই জায়গায় আসে না, এই দেশ বিশ্বকাপের আয়োজক হয় না। সেখানেই পেছনের দরজা দিয়ে একটা ঝামেলা করতে চেয়েছিল আয়ারল্যান্ড। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওরা অল্প রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল, এত অল্প যে লাঞ্চের পর আয়েশ করেই রানটা তুলে ফেলার কথা বাংলাদেশের। হঠাৎ বৃষ্টির আঘাত। তারপর দুটো ঘটনা ঘটল। একটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের চিরকালীন
অ্যালবামে জ্বলজ্বল করে জ্বলার মতো। ম্যাচ না হলে পয়েন্ট ভাগাভাগি, তাতে সেমিফাইনাল তথা বিশ্বকাপ সম্ভাবনা অনিশ্চয়তাকবলিত হয়, ওদিকে মালয়েশিয়ানরা ক্রিকেট মাঠ বৃষ্টির পর কিভাবে শুকাতে হয় ঠিক জানে না। বাংলাদেশের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে দলের সঙ্গে যাওয়া সাংবাদিকরা পর্যন্ত নেমে গেলেন মাঠ শুকাতে। গাজী আশরাফ লিপু বালতি টানছেন, আমিনুল-আকরামরা তোয়ালে ভেজাচ্ছেন, সাংবাদিকরা পানি সরানোর চেষ্টা করছেন, ক্রিকেটকে ছাপিয়ে ওটা হয়ে উঠেছিল দেশপ্রেমের চিরন্তন ছবি। সেই ছবি এখন আরো কত জ্বলজ্বলে। এখন পুরো দেশ ক্রিকেটের ভাষায় কথা বলে, ক্রিকেটের ছন্দে নাচে, ক্রিকেটের ডানায় ওড়ে। যাই হোক, এই মিলিত চেষ্টায় মাঠটাকে খেলার মতো পর্যায়ে আনা গেল। খেলা শুরু হলো এবং শুরু হলো আইরিশদের নাটকও। মাঠে গিয়ে ওরা শুকনা জায়গায় আছাড় খেয়ে পড়তে থাকল, যেন এই মাঠে খেলতে গেলে ওদের জীবন যাবে। অবিবেচক আম্পায়ারও অভিনয়ের ফাঁদে পড়ে খেলা বন্ধ করে দিলেন। বাংলাদেশ নিশ্চিত ১ পয়েন্ট হারাল এবং সমীকরণটা এমন দাঁড়াল যে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে পরের ম্যাচ না জিতলে এবারও বিশ্বকাপের টিকিট পাওয়া যাবে না। জানিয়ে রাখি, তখনকার নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের শক্তির পার্থক্য ছিল খুব সামান্য। আগের আইসিসি ট্রফিতেই বাংলাদেশ হেরেছিল। কাজেই...। সেবারও হারতে বসেছিল, আকরাম খান স্বপ্নের ইনিংস খেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অনিশ্চয়তার এঁদোগলি থেকে নিয়ে গেলেন গৌরবের হাইওয়েতে। সেটা ধরে ছুটেই এখন আমরা বিশ্বকাপের আয়োজক। আয়ারল্যান্ডের সেই কীর্তিটা (!) আর খুব মনে ছিল না। পথ পেরিয়ে গেলে পথের দুঃসহ কষ্টটাও ঠিক আর স্মৃতিতে থাকে না, কখনও কখনও কৌতুকের গল্পই হয়ে যায় বরং। তাই হয়ে গেল। আমরা চললাম উপরের দিকে, আয়ারল্যান্ড নামল নিচের দিকে। আর ঠিক দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। হলো একবার। ২০০৭ বিশ্বকাপে। তত দিনে আমাদের উৎরাই আর ওদের চড়াইতে বাংলাদেশের জন্য ম্যাচটাকে মনে হয়েছিল নিয়মরক্ষার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কিন্তু ওরা পাল্টা আঘাত করে স্বপ্নের বিশ্বকাপযাত্রায় কালি মাখাল। সেই বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে সুপার এইটে ওঠা এবং তারপর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর বিশ্বকাপ স্মৃতিটা বাঁধিয়ে রাখার মতো, কিন্তু যতবার পেছনে ফিরি ততবারই একটা খোঁচা। আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সেই ম্যাচ। চাঁদের মধ্যে ওটা হয়ে আছে কলঙ্ক। টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আরেকবার মুখোমুখি। কী আশ্চর্য, সেবারও প্রতিশোধ হলো না, হলো আরেকটা বেদনার কাব্য, আরেকবার আইরিশ তীরে বিদ্ধ বাংলাদেশের হৃদয়। হিসাবের খাতায় তাই অনেক বকেয়া। আইরিশ ইতিহাসের পেটে ঢুকে থাকা আমাদের সেই এক পয়েন্ট, বিশ্বকাপ স্বপ্নযাত্রায় কাঁটা হয়ে থাকা বার্বাডোজের সেই ম্যাচ, টোয়েন্টি-টোয়েন্টিতে আমাদের গায়ে মাখানো অগৌরবের ধুলা! এসবের বদলা নিতে তো করতে হবে সামান্য একটা কাজ। আজ আয়ারল্যান্ডকে হারানো।
সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে একজনের মিল পাওয়া যায়। হোসে মরিনহো। ধুরন্ধর বুদ্ধি আর ফুটবল প্রজ্ঞায় এই পর্তুগিজ আধুনিক ফুটবলের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানী। মাথার সঙ্গে তাঁর মুখও খুব চলে; দারুণ সব কথা বলে ম্যাচের আগে মাঠ গরম করায় অতুলনীয়। সাকিবেরও কিন্তু মুখ বেশ ভালো চলে। বলার নয় এমন অনেক কথা বলে ফেলেন অকপটে। কিন্তু বিশ্বকাপ আসতে কেমন যেন একটু মিইয়ে গেছেন। সংবাদ সম্মেলনগুলোতে ঠিক তাঁর মতো সপ্রতিভ নন। বিশ্বকাপ বলে! বিদেশি সাংবাদিক থাকেন বলে! মরিনহোর কথা যে জন্য বলছিলাম, চেলসির কোচ থাকা অবস্থায় বার্সেলোনার কাছে একবার হেরেছিল তারা, তা পরেরবার যখন মুখোমুখি তখন সাংবাদিকরা ধরল, আপনি কি প্রতিশোধের কথা ভাবছেন! মরিনহো স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, 'আচ্ছা যদি সেই ম্যাচটা আমরা জিততাম তাহলে কি এই ম্যাচটা জেতার চেষ্টা করতাম না! সব ম্যাচই তো জেতার জন্য খেলি।' এটুকু বলার পর একটু থেমে কী ভাবলেন যেন। তারপর বললেন, 'আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা যখন এত প্রতিশোধের কথা বলছ তাহলে চলো, প্রতিশোধই না হয় নিয়ে নিই।' সাকিবের দিকেও কাল এমন উস্কানি ছিল কিন্তু সাকিব কেন যেন সেটা উড়িয়ে দিলেন। তিনি বরং বাংলাদেশ যে বিশ্বকাপের পর আয়ারল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ হারিয়েছিল সেটার দিকেই গুরুত্ব দিতে চাইলেন। তথ্য হিসাবে পুরো সঠিক। কিন্তু মাঝে মধ্যে মাঠে যেমন ব্যাকরণের বাইরে বেরিয়ে খেলতে হয়, তেমনি মাঝে মধ্যে হিসাবের বাইরেও যেতে হয়। একটা সিরিজ হারানোতে বিশ্বকাপের ক্ষতিপূরণ হয় না, তাঁর জন্য আরেকটা বিশ্বকাপে জয় লাগে। সাকিবের মতো তুখোড় এবং মুখর অধিনায়ক এটা জানবেন না! সম্ভব! সংবাদ সম্মেলনে বিনীত এবং হিসেবি সাকিবকে দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে পড়ল, আরে আগের দিনই তো মুশফিকুর রহিম প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন! যুদ্ধে এটাও কিন্তু কখনো কখনো কৌশল যে সেনাপতি চুপচাপ থাকবেন, তাঁর সঙ্গী-সাথিরা রণডঙ্কা বাজাবে। মুশফিক কি সেনাপতির সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত দূত! হলে ভালো। দরকার কিন্তু আছে। আয়ারল্যান্ড যে বাংলাদেশের উৎসব পণ্ড করার ঘোষণা দিচ্ছে প্রকাশ্যে, তাদের কেউ কেউ অঙ্ক করে দেখাচ্ছেন বড় আসরে বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে পারে না, তার প্রাক ম্যাচ জবাবও তো দরকার ছিল।
দরকার কিন্তু অনিবার্য নয়। প্রাক ম্যাচ লড়াইটা হয় মাঠের অঙ্কটা নিজেদের দিকে টেনে আনতে, সেটাতে হেরে গেলে সমস্যা নেই। সমস্যা মাঠের লড়াইয়ে হারলে। সেই হার কিন্তু এই বিশ্বকাপমাখা বাংলাদেশ হজম করতে পারবে না। স্বপ্নে আমরা এমন রঙিন। কল্পনায় আমরা এমন বিলাসী। ভালোবাসায় আমরা এমন আন্তরিক যে আজকের জয়টা আসলে আমাদের পাওনা। আমাদের হৃদয় রক্তাক্ত হলে বিশ্বকাপও কিন্তু রক্তিম হবে।
দেখি বিশ্বকাপ আমাদের পাওনা মেটায় কি না। দেখি, ক্রিকেটাররা স্বপ্নের রং শরীরে ধারণ করতে পারেন কি না। আর চুপি চুপি দেখি, প্রতিশোধটা হয় কি না!
সাকিব, সবাই যখন এত পীড়াপীড়ি করছে তখন প্রতিশোধটা না হয় নিয়েই নিন!

No comments

Powered by Blogger.