এই দিনে- সেই যুবকের নাম নূর হোসেন by পাভেল রহমান

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পতনের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক জোট সারা দেশে অবরোধের ডাক দেয়। যদিও আন্দোলনের হূৎস্পন্দনটা ছিল রাজধানী ঢাকাতেই। তবে এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে বাইরের শহরগুলোতেও। বিরোধী দলের লাগাতার আন্দোলনের একপর্যায়ে ১০ নভেম্বর অবরোধের ডাক দেওয়া হয়।


অবরোধ মানে সরকারকে অচল করে দেওয়া। আর সরকার সেই অবরোধ ভাঙতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
সকাল থেকেই সব দলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে পল্টন এলাকায় আসছিলেন। অন্যদিকে সরকারের পুলিশ, বিডিআর ও আনসার বাহিনীও প্রস্তুত ছিল। দুই পক্ষ একেবারে মুখোমুখি অবস্থানে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক উপস্থিতি দেখাতে কঠোর ব্যবস্থা নেয় সরকার। অনেকে আগের রাতেই চলে আসেন সচিবালয়ে। সেখানে তাঁরা যে টেবিলে মশারি টানিয়ে মাথায় ফাইল দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন, সেই ছবিও তুলেছি আমি।
বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিক্ষোভকারীদের রুখতে তৈরি করা হয় বাঁশের ব্যারিকেড। মৎস্য ভবন থেকে বঙ্গবাজার, শাহজাহানপুর থেকে নবাবপুর, টিকাটুলী থেকে মালিবাগ—সর্বত্র পুলিশ, বিডিআর ও আনসাররা যুদ্ধসাজে প্রস্তুত। এককথায় ১০ নভেম্বর সকালেই মনে হচ্ছিল, ‘আজ বড় কিছু ঘটতে চলেছে।’
একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে আমি সকাল থেকেই পরিস্থিতি আঁচ করছিলাম। সুজুকি ১২৫ সিসির বাইকটা আমার সঙ্গী। ২০ পকেটের যে জ্যাকেটটা বড় বোন লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে পাঠিয়েছেন, সেটি ছিল আমার গায়ে। ওই পকেটগুলোতে সাদাকালো ৩৫ মিমি ফিল্মে ঠাসা। সঙ্গে দুটি ক্যামেরার একটিতে ওয়াইড, অন্যটিতে টেলিলেন্স। আমার সাজটাও কম নয়। ভোরেই পুরো শহরটা চক্কর দিয়ে মনে হচ্ছিল, তাপটা যেন পুরানা পল্টন ঘিরেই। এখানেই একটা কিছু ঘটবে।
শীতের আমেজটা ভোরের সূর্য ওঠার পর যেমন ছিল, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তেমন থাকল না। লালের চেয়েও লাল হয়ে উঠল মিছিলকারীদের হাতে লাল সূর্যখচিত সবুজ পতাকা। দুই প্লাটুন পুলিশের সামনে শ খানেক বিক্ষোভকারী। তোপখানা সড়কের মোড়ে পুলিশ বক্সের সামনে দাঙ্গা পুলিশ। আর উল্টো দিকে বাসস অফিসের সামনে দৈনিক বাংলামুখী সড়কে লাল পতাকাবাহী বিক্ষোভকারীদের ওপর এক পশলা ইষ্টক নিক্ষেপের ঘটনা ঘটল। দুই পুলিশের এক হাতে অস্ত্র, অন্য হাতে ইট নিক্ষেপের ভালো একটা কম্পোজিশন ধরা পড়ল আমার ক্যামেরায়। অর্থাৎ পুলিশই মিছিলকারীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে উসকানি দিচ্ছে। দিনের প্রথম ছবি। রাস্তায় ব্যারিকেডের চেয়ে ঢের আকর্ষণীয় মনে হলো এটি। অ্যাকশন না হলে নিউজ ছবি জমে না।
তোপখানা রোডে প্রেসক্লাবের দিক থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এলেন ছাই রঙের জিপে চড়ে। পাদানিতে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেই স্লোগান দিচ্ছিলেন। তাঁর পেছনে বিশাল কর্মীবাহিনী। তাঁরা এগিয়ে এলেন পল্টনেই। তারপর ডানে ঘুরে জিপিওর পথে। চলন্ত জিপের ওপর শেখ হাসিনার স্লোগানদীপ্ত ভঙ্গিমা ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ফোরগ্রাউন্ডে প্রতিবাদী কর্মীদের দারুণ অ্যাকশন ছবি তুলতে থাকলাম আমি।
তখন শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করা জরুরি হলেও মন পড়ে থাকে পল্টনে।
বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের রাজপথে তখন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পিচঢালা পথেই তিনি অবস্থান নিয়েছেন কর্মীবাহিনীর সঙ্গে। সেই ছবি তুলে আবার ফিরে আসি পল্টনে।
পল্টন যেন আমাকে আটকে রাখে। বারবার ফিরে আসি।
দুই নেত্রী দুই দিকে আর লাল পতাকার দল মাঝখানে। তাদের অবস্থান ঘিরেই যত শঙ্কা। বিক্ষোভকারীরা এলোমেলো স্লোগান দিচ্ছেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। হাতে ছোট ছোট লাল পতাকা। আলোর বিপরীতে লাল পতাকার ছায়া, তাও ছবি হয়ে যায়।
এমন সময় আমার শরীর ঘেঁষে হেঁটে যান এক যুবক। শ্যামল গড়ন কোঁকড়া চুলের সেই যুবকের দীর্ঘ পিঠে সাদা কালিতে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগানে আটকে যায় আমার চোখ। মুহূর্তে শরীরে একধরনের শিহরণ সৃষ্টি হয়। যেন চোখে উঠে আসে ক্যামেরা। আমি ভিউফাইন্ডারে স্পষ্ট দেখি সেই স্লোগান। আমার ডান হাতের তর্জনী সচল হয়। নিমেষে ফ্রেম ভর্তি হয়ে যায় সেলুলয়েডের ফিতায়।
এরপর, হ্যাঁ এরপর সেই যুবকের কণ্ঠে উঠে আসে প্রতিবাদী ঝড়। এলোমেলো কোঁকড়া চুলে চিরুনি চালান যুবক। যেন নিড়ানি দেওয়া খেতে কেবল বুনেছেন তিনি গণতন্ত্রের বীজ। আমার ক্যামেরায় মুহূর্তে আবারও ফ্রেম-বন্দী করি সেই ছবি।
মুহূর্তে আমি ওঁকে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে ফেলি। যেন আর পাঁচজন এমন ছবি না তুলে ফেলে।
কিন্তু সত্যি সত্যি আমি হারিয়ে ফেলি তাঁকে মিছিলে। একটু আগেই মিছিলটা শুরু হয়েছিল পল্টন থেকে। জিপিও হয়ে স্টেডিয়ামের দিকে এদিক-ওদিক কোথাও খুঁজে পাই না তাঁকে। কোথা থেকে বিআরটিসির ট্রাকে এল বন্দুক উঁচিয়ে ধরা সশস্ত্র পুলিশ ও আনসার বাহিনী। ওদিকে মিছিল চলছিল। এর পরই গুলি। কে একজন ততক্ষণে পড়ে গেল রাজপথে। সতীর্থরা একটা রিকশায় তাকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালের দিকে। ইতিমধ্যে কারফিউ জারি হয়ে যায়। পথের মধ্যেই পুলিশ কেড়ে নিল সেই যুবককে। সারা দিন তাঁর রক্তাক্ত দেহ পুলিশের গাড়িতেই পড়ে থাকল।
সেই যুবকের নাম নূর হোসেন, যিনি আমাদের গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন।
পাভেল রহমান

No comments

Powered by Blogger.