আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-১৪)-ধূপখোলা মাঠ দেখে আনন্দে উদ্বেলিত by আলী যাকের

গেণ্ডারিয়ায় আমাদের গুছিয়ে-গাছিয়ে বসতে বেশ কিছু দিন লেগেছিল। সেখানে আমাদের শুরুর দিনগুলো স্মৃতির পাতায় কেমন যেন ধূসর হয়ে গেছে। তবুও মনে পড়ে, বাড়ির খুব কাছে বিশাল ধূপখোলা মাঠ দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম। একদিকে আমবাগান, আরেক দিকে পাড়ার বসতবাটি, বিশাল এক প্রান্তর ছিল ওই ধূপখোলা মাঠ।


তখন পর্যন্ত কলকাতার গড়ের মাঠ দেখেছিলাম এবং সেটিই ছিল আমার দেখা সবচেয়ে বড় মাঠ। ভাবতাম, ইস্ আমাদের ঢাকায় যদি এমন একটা মাঠ হতো। যদিও গড়ের মাঠের মতো বড় নয়, তবুও ধূপখোলার মাঠ আমার মন ভরিয়ে দিল। প্রথম দিকে আমি ভোর বেলা উঠে খোলা মাঠের ওপর হাঁটতাম। পা শিশিরে ভিজে যেত। পাশের আমবাগানে গাছের ওপর উঠে বসতাম। নানা কথা ভাবতাম। ভাবতাম খুলনার কথা, কুষ্টিয়ার কথা। ওই সাত-সকালে পাড়ার দু-চারজন বয়স্ক মানুষ মাঠে হাঁটতে আসতেন। আর আসতেন ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের কয়েকজন ফুটবল খেলোয়াড়। তাঁরা প্র্যাকটিস করতেন মাঠে। আমি দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে দেখতাম। একসময় আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় চলে আসতাম। প্রতিটি সকালে ওই মাঠ আমায় টানত। সেই বাচ্চা বয়স থেকে উন্মুক্ত আলোময় পৃথিবীতে মানুষ হওয়া আমি ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারতাম না। ছোটবেলা থেকেই আমি বাইরের মানুষ। এ রকম একদিন সকাল বেলায় আমগাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অদূরে কতগুলো নানা বয়সী ছেলে ফুটবল খেলছিল। খেলা শেষে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'ওয়াটারম্যান'। আমি সব সময়ই স্থূলকায়। মায়ের কাছে শুনেছিলাম, আমি জন্মের সময়ই বেশ বড় আকৃতির ছিলাম। পরে কেউ আমার মোটাত্ব নিয়ে কটাক্ষ করলে বলতাম, 'আই ওয়াজ বর্ন ইলেভেন পাউন্ডস অ্যান্ড নেভার লুকড ব্যাক।' আকৃতি নিয়ে কম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি বিভিন্ন সময়ে। যা হোক, কথাটি সত্য যে গড়পরতা বাঙালির চেয়ে আমি একটু বেশি ওজনদার ছিলাম। সেই 'ওয়াটারম্যান' সম্বোধনের মধ্য দিয়েই আমার সখ্য হয়ে গেল গেণ্ডারিয়ার বালকদের সঙ্গে। অজয়, সিরাজুল, নবদ্বীপ, রফিক, ডলু, বেলু মজনু, মোহিতদের সঙ্গেই পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম। ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলতাম। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে হয়। সেই যে প্রথম সকালে আমাকে 'ওয়াটারম্যান' সম্বোধন করা হয়েছিল, যার মানে জলভরা মানুষ, সে বিষয়টি সম্পর্কে ওদের আমি আর কিছু বলিনি। এর কারণ স্থূলকায় মানুষকে আমি নানা রকম সম্বোধনে ডাকতে শুনেছি। কিন্তু 'জলভরা মানুষ' বোধ হয় সেই প্রথম। অতএব এক ধরনের মজাই লেগেছিল বলতে গেলে। পরে আমার মেট্রিক পরীক্ষার আগে একটা ওয়াটারম্যান কলম পেয়েছিলাম এবং জেনেছিলাম যে সেটি জার্মান কলমের একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ড। এই যে আমার বন্ধুদের ওয়াটারম্যান সম্বোধনকে আমি শুধরে দিইনি, বলিনি যে মোটাকে মোটা বলতে হয়, জলভরা মানুষ নয়, এর কারণ বোধ হয় মানুষের সঙ্গে চলতে হলে, সখ্য রাখতে হলে সংশোধন যত কম করা যায় ততই ভালো। আমার বন্ধুরাও নিশ্চয়ই আমার অনেক ভুল ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখেছে। সেটাই স্বাভাবিক।
গেণ্ডারিয়ায় আমার কৈশোরের দিনগুলো উদ্যাম গতিতে কেটেছে। দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর। ১২টি বছর দেখতে না দেখতে পার করে দিয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি মানুষের জীবনে যা যা ঘটতে পারে সুখ-দুঃখের, তার সবই আমার জীবনে এসেছে, গেছে। এখানে থাকতেই আমার স্কুলে যাওয়া শুরু। আমি সরাসরি ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়েছি। এ বিষয়টি আজকের বাচ্চারা শুনলে আঁৎকে উঠবে। এমনকি আমি নিজেও একজন বাবা হিসেবে আঁৎকে ওঠি। কিভাবে সম্ভব হয়েছিল এটা? আসলে এর পেছনে অবশ্যই একটা কারণ ছিল। আমার বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেহেতু আমাদের স্কুলে যাওয়ার শুরুটা বিলম্বিত হয়েছিল। তা ছাড়া আরো যে বড় কারণটি এর জন্য দায়ী বলে আমি মনে করি_সেটি হলো তখনকার জীবনের গতি। আজকের মতো এত প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা ছিল না তখন। স্কুল-কলেজ পার করে মোটামুটি একটা ডিগ্রি অর্জন করতে পারলেই একটা চাকরি ছিল সুনিশ্চিত; এবং যেহেতু আমরা জাগতিক জীবনে খুব একটা ওপরে ওঠার কথা কেউ চিন্তা করতাম না, খাওয়া-পরা নিশ্চিত হলে হেসে-খেলে জীবন গড়িয়ে যেত, সেহেতু আমি ক্লাস ফোরে স্কুলে গেলাম, নাকি ক্লাস ওয়ানে, তা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা ছিল না। এই যে স্কুল শুরু করার একটা ঢিলেঢালা ভাব, তা আমাদের সুযোগ করে দিয়েছিল শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার সময়টিতে আমাদের মা-বাবা, ভাইবোন এমনকি আত্মীয়স্বজনকেও আরো ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়ার। ইংরেজিতে ওই বয়সটিকে বলে ওসঢ়ৎবংংরড়হধনষব অমব. সেই যে বাধাহীন জীবনের একটা আলস্য ভাব মনের মধ্যে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছিল, সে ভাবটিই আমাকে এই দর্শনে দীক্ষিত করে যে 'আলস্যই সকল সুখের মূল'। ফলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, 'ছুটির দিন বেড়ে যায়, কাজের দিনের চেয়ে'_এমন একটি অবস্থা ছিল আমাদের।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.