নববর্ষ-বাংলা পঞ্জিকার আরেকটি সংস্কার প্রত্যাশায় by ম. ইনামুল হক

বাংলাদেশের পঞ্জিকাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বা তাদের অন্যান্য বাংলাভাষী অঞ্চলে গৃহীত হয়নি। সেখানে ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপিত হয়। আমি তাই বাংলা পঞ্জিকার আরেকটি সংস্কার করে ১ বৈশাখ ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ এপ্রিল করতে বলছি। এর ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন হবে, দুই বাংলায় একই দিন নববর্ষ হবে


বাংলা পঞ্জিকার বয়স ১৪১২ বছর শেষ হচ্ছে। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক বলেন, মোগল সম্রাট আকবরের সময় তার সভাসদ আমির ফতেউল্লা সিরাজী ১৫৫৬ ইংরেজি সালে পঞ্জিকাটির প্রচলন করেছিলেন। এই সভাসদ একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি হিজরি সন অনুযায়ী খাজনা আদায়ের অসুবিধা দূর করার জন্য চান্দ্র হিজরি বছরকে সৌরবছরে রূপান্তর করে বাংলা সনের জন্ম দেন। এই কথাটি ঠিক নয়
বাংলা সন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে প্রচলিত একই সময়ে শুরু হওয়া পঞ্জিকাগুলোরই একটি ঐতিহ্যপূর্ণ পঞ্জিকা। মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ ফতেউল্লা সিরাজী বাংলা সন নতুন করে উদ্ভাবন করেননি বরং তিনি বাংলার সমতলে চলতি বাংলা পঞ্জিকাকে খাজনা আদায়ের বছর হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রবন্ধে উপরোক্ত যুক্তির যথার্থতা প্রমাণ এবং এর বর্তমান অবস্থার কিছুটা সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলা পঞ্জিকা :বর্তমান বাংলা পঞ্জিকা একটি ফসল পঞ্জিকা। এর প্রথম দিনটি থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সময়ে রয়েছে বাংলার তিনটি ফসল মৌসুম। এই মৌসুমগুলো যথা আউশ, আমন ও রবি বাংলা বছরকে চার মাস ধরে সহজেই ভাগ করে চিহ্নিত করা যায়। এই পঞ্জিকার প্রথম দিন নববর্ষ হিসেবে ও শেষ দিন হালখাতা হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব ও ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয়।
বাংলা পঞ্জিকার ব্যাপারে একটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই যে, কেবল বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, বাংলা নতুন বছর আগমনের সন্ধিক্ষণের কয়েকটি দিন সারা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একই সময়ে (১৪-১৫ এপ্রিল) বিশেষ ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয়। এসব দেশ হলো_ কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কিছু অংশ, শ্রীলংকা, তামিলনাড়ূ, অন্ধ্র, কেরালা, উড়িষ্যা, বিহার, আসামসহ সমগ্র উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারত, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও কাশ্মীর।
বাংলা ও ভারতীয় পঞ্জিকা :মোঃ আবু তালিব 'বাংলা সনের জন্মকথা' বইটিতে লিখছেন : কিছু পণ্ডিতের মতে, আমির ফতেউল্লা সিরাজী বাংলা সন প্রবর্তনের সময় মহারাষ্ট্রের শকাব্দ পঞ্জিকা থেকে মাসগুলোর নাম গ্রহণ করেন (পৃষ্ঠা ২১)। এই ধারণা অসত্য এবং লেখকের মনগড়া। কারণ বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের নাম শকাব্দ পঞ্জিকায় কুনওয়ার (পৃষ্ঠা ২৫)। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা মাসের নামগুলো ষোড়শ মহাজনপদের সময়ে চিহ্নিত মহাকাশের নক্ষত্রগুলোর নাম থেকে নেওয়া হয়েছে।
মোগল আমলে রাজস্ব আদায়ের গুরুত্ব কিংবা অন্য কোনো প্রশাসনিক প্রয়োজন যাই ছিল না কেন, আমাদের আজকের জাতীয় জীবনে বাংলা পঞ্জিকার গুরুত্ব অপরিসীম। এই পঞ্জিকা হিজরি থেকে ভিন্ন জাতের, শকাব্দ থেকে ভিন্ন ঐতিহ্যের এবং খ্রিস্টাব্দ থেকে ভিন্ন ঋতুবৈচিত্র্যের। তাছাড়া বর্তমান বাংলা পঞ্জিকার গোড়ার বছর এমন এক সময় (৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) নির্দেশ করে যখন বাংলার সমতলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে।
বাংলার ইতিহাস লিখতে গেলে আমরা আলেকজান্ডারের সময়ের পূর্বে কোনো কিছু নির্দিষ্টভাবে পাই না। আলেকজান্ডার ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পশ্চিম ভারত জয় করেন। মেসিডনীয় এই বীরের সৈন্যরা ভারতের পূর্বাংশে দুটি বিশাল দেশের যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা জানতে পেরে তাদের প্রভুর আদেশ অমান্য করে ফিরে যায়। বঙ্গ ও মগধ এলাকায় তখনকার এই দুটি দেশের নাম ছিল গঙ্গারাঢ়ী এবং প্রাচ্য।
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের মতে (সূত্র ৩), প্রাচীন বাংলার সীমা পশ্চিমে ছোট নাগপুরের মালভূমি থেকে পূর্বে লুসাই-আরাকানের পাহাড় পর্যন্ত এবং উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। খ্রিস্টীয় ৬ শতক পর্যন্ত বাংলার এই সমতলে বহু রাজা এবং রাজবংশ শাসন করেছে, কিন্তু তাদের জাতীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে যারা তাদের রাজধানী পাটলিপুত্র, গৌড়, পুণ্ড্র অথবা প্রাচীন বাংলার কোথাও স্থাপন করেছিল তাদের বাংলার ভূমিপুত্র বলে ধরা যেতে পারে।
খ্রিস্টীয় ৬ শতকের শেষ দশকে রাঢ়বঙ্গে শশাঙ্ক নামের এক শক্তিশালী রাজার উত্থান হয়। শশাঙ্ক মগধের রাজা মহাসেনগুপ্তের মৃত্যুর পর (৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ) গৌড় ও মগধ দখল করে নেন এবং নিজেকে পঞ্চ গৌড়েশ্বর বলে ঘোষণা করেন। শশাঙ্ক এরপর থানেশ্বরের রাজাকে পরাজিত করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, শশাঙ্কই প্রথম বাঙালি রাজা যার অধীনে এতে বড় এক সাম্রাজ্য ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, শশাঙ্ক ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান মুর্শিদাবাদের ১০ কিমি দূরে কর্ণসুবর্ণ (বর্তমানে কানসোনা) নামক স্থানে তার রাজধানী স্থাপন করেন। এই ইতিহাস যদি সত্যি হয়, বর্তমানকালের বাংলা সৌরপঞ্জিকার শুরুর বছর শশাঙ্কের রাজধানী স্থাপনের বছরকেই নির্দেশ করে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের পর সারাদেশের জন্য একটি একই প্রকার পঞ্জিকা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সরকার ১৯৫২ সালের নভেম্বরে ড. মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। সরকারের কাছে মেঘনাদ সাহা কমিটির সুপারিশ ছিল নিম্নরূপ_
নাক্ষত্রীয় পঞ্জিকার (ংরফবৎবধষ পধষবহফধৎ) পরিবর্তে ক্রান্তীয় পঞ্জিকা (ঃৎড়ঢ়রপধষ পধষবহফধৎ) চালু করা_
১. বছরের শুরু বৈশাখের পরিবর্তে চৈত্র থেকে;
২. চৈত্র মাস ৬-৭ দিন দেরি করে শুরু (ঃৎড়ঢ়রপধষ ুবধৎ);
৩. শকাব্দকে জাতীয় পঞ্জিকা ঘোষণা।
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ড. শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা সংশোধনের জন্য অনুরূপ একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ ছিল নিম্নরূপ_
১. মোগলদের সময় থেকে চালু বাংলা পঞ্জিকাকে জাতীয় পঞ্জিকা করা;
২. বছরের হিসাব হিজরি বছরের গণনা হিসাবে গ্রহণ করা (বর্তমান ১৩৭৩ বাংলা);
৩. বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ৩১ দিনের এবং অন্যান্য ৩০ দিনের করা;
৪. অধিবর্ষের (ষবধঢ় ুবধৎ) জন্য চৈত্র মাসে একটি অতিরিক্ত দিন হিসাব করা।
মেঘনাদ সাহা কমিটির সুপারিশ ভারতীয় সরকার গ্রহণ করলেও ঐতিহ্যবিরোধী হওয়ায় জনপ্রিয় হয়নি। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সাহা কমিটির সুপারিশ পুনর্নিরীক্ষা এবং একটি জাতীয় পঞ্জিকার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার আরেকটি কমিটি গঠন করে। ভারতীয় জ্যোতিষী এবং পানচাঙ পণ্ডিতদের মধ্যে একটি দৃঢ়মত এই যে, যেদিন সূর্য তার যাত্রাপথে নাক্ষত্রিক মেষরাশির (ঝরফবৎবধষ অৎরবং) প্রথম বিন্দুতে পেঁৗছায়, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল জাতীয় পঞ্জিকাটির প্রথম দিন করা হোক।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সালে বাংলা পঞ্জিকার ক্ষেত্রে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে। ১৪ এপ্রিল বছর শুরুর দিন ধার্য করা হয় এবং খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার অধিবর্ষের বছরে ফাল্গুন মাসে একদিন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আরেকটি সংস্কার প্রস্তাবনা : আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। ওই দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮। বর্তমান বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারি ৯ ফাল্গুন হয়। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে গৃহীত হওয়ায় ৮ ফাল্গুন উদযাপনের কথা উঠছে। বাংলাদেশের পঞ্জিকাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বা তাদের অন্যান্য বাংলাভাষী অঞ্চলে গৃহীত হয়নি। সেখানে বাংলা পুরনো পঞ্জিকাই চলে। সেখানে ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপিত হয়।
আমি তাই বাংলা পঞ্জিকার আরেকটি সংস্কার করে ১ বৈশাখ ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ এপ্রিল করতে বলছি। এর ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন হবে, দুই বাংলায় একই দিন নববর্ষ হবে। আমাদের দেশের মেয়েরা ফাল্গুনের প্রথম দিনে শখ করে হলুদ শাড়ি পরে যে বসন্ত উৎসব করে, এই সংস্কারের ফলে ঐ দিনেই 'ভ্যালেন্টাইন ডে' বা 'ভালোবাসা দিবস'ও হবে।

প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক : সাবেক মহাপরিচালক, পানিসম্পদ
পরিকল্পনা সংস্থা

No comments

Powered by Blogger.