ব্যবস্থা নিচ্ছে না শ্রম মন্ত্রণালয়- জালিয়াতি করে সরকারি কাজ পেয়ে আবার জালিয়াতি by শরিফুল হাসান

জালিয়াতির মাধ্যমে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে জনবল সরবরাহের কাজ পেয়েছে প্রটোকল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জামানত হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির জমা দেওয়া দুটি পে-অর্ডারই জাল বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পে জনবল সরবরাহের পর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নাম ব্যবহার করে অবৈধভাবে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ব্যাংক ড্রাফট নিয়েছে।


প্রকল্পে সরবরাহ করা কর্মীদের বেতন থেকে টাকা কেটে রাখার অভিযোগও রয়েছে প্রটোকলের বিরুদ্ধে।
‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পে’ ঘটেছে এ ঘটনা। ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে প্রটোকলের মালিক বরকত হোসেন বলেছেন, এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।
প্রকল্পটির পরিচালক এম এ কাশেম মাসুদ বলেছেন, জাল পে-অর্ডারের বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই। অপর দুটি অভিযোগের বিষয়ে তাঁরা ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রটোকল গত বছরের সেপ্টেম্বরে ওই প্রকল্পে ২৮ জন জনবল সরবরাহের কাজ পায়। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে প্রকল্প থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পায়। এ ছাড়া সরবরাহ করা ২৮ জনের মোট বেতন দুই লাখ ২৮ হাজার ৯৬৯ টাকাও তারা তুলে কর্মীদের দেয়।
প্রটোকলের মালিক বরকত হোসেন খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। ২০১০ সালের ৩১ মে ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে নেওয়া তাঁর ট্রেড লাইসেন্সে ঠিকানা রয়েছে খুলনার খালিশপুর।
জাল পে-অর্ডার: নথিপত্রে দেখা যায়, জামানত হিসেবে প্রটোকল দুটি পে-অর্ডার জমা দিয়েছে। এর একটি উত্তরা ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখা ও অপরটি পূবালী ব্যাংকের পিলখানা শাখা থেকে করা। তবে এই দুটি পে-অর্ডারই জাল। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রটোকল ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরা ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখা থেকে ৮৯০৮৬৬৪ নম্বর পে-অর্ডারের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালক বরাবর এক লাখ ৩৭ হাজার ৩৮২ টাকা জমা দেয়।
তবে উত্তরা ব্যাংকের ওই শাখার প্রধান সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘৮৯০৮৬৬৪ নম্বরে আমাদের শাখা থেকে কোনো পে-অর্ডার করা হয়নি। ওই পে-অর্ডারে থাকা স্বাক্ষরও জাল।’ প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে ওই পে-অর্ডারের সত্যতা যাচাই করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো কেউ এ ব্যাপারে জানতে চায়নি।’
প্রটোকল ২০১১ সালের ২৪ অক্টোবর ৬৫৪৯১৬৫ নম্বরের একই পরিমাণ টাকার আরেকটি পে-অর্ডার জমা দেয়। এটি ছিল পূবালী ব্যাংকের পিলখানা শাখার। ওই শাখার ব্যবস্থাপক এ কে এম আবদুর রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই সিরিয়াল নম্বরে কোনো পে-অর্ডার আমাদের শাখা থেকে করা হয়নি। ওই পে-অর্ডারে থাকা স্বাক্ষরও জাল।’
পে-অর্ডার জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে বরকত হোসেন বলেন, ‘আমি তো আর ব্যাংকে পে-অর্ডার জমা দিইনি। দিয়েছে আমার লোকজন। কাজেই আমার জানা নেই। আর সরকার বা মন্ত্রণালয়ের কেউ তো কখনো বলেনি যে এটা জাল, তা হলে আপনার এ নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন?’
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এ বিষয়ে তাঁদের কাছে তথ্য নেই। বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরা খোঁজখবর নেবেন। জাল হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ব্যাংক ড্রাফট: প্রটোকল শ্রম মন্ত্রণালয়ের নাম ব্যবহার করে ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর এই প্রকল্পে জনবল নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়। বিজ্ঞপ্তিতে অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে ৯২ জন, চালক দুজন, এমএলএসএস কাম মেসেঞ্জার ৯২ জন, প্রহরী একজন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে একজনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়। প্রথম দুটি পদের জন্য আগ্রহী ব্যক্তিদের ২০০ টাকার ও পরের তিনটি পদের প্রার্থীদের ১০০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট প্রটোকল বরাবর পাঠাতে বলা হয়। অথচ এর আগেই প্রটোকল ওই প্রকল্পে জনবল সরবরাহ করে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওই বিজ্ঞপ্তি দেখে অনেক প্রার্থী ব্যাংক ড্রাফটসহ আবেদন করে প্রতারিত হন। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘জনবল সরবরাহ করার পরও প্রটোকল মন্ত্রণালয়ের নাম ব্যবহার করে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অন্যায় করেছে। আমরা বিষয়টি দেখার পরপরই তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিই। যাদের কাছ থেকে তারা ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে টাকা নিয়েছে, তাদের টাকা ফেরত দিতে বলেছি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করতে বলেছি। আমরাও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। থানায় জিডি করেছি।’
এ বিষয়ে প্রটোকলের মালিক বলেন, ‘আমি প্রকল্পে লোক নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম, মন্ত্রণালয়ে লোক নেওয়ার জন্য নয়।’
বেতন থেকে অর্থ কাটার অভিযোগ: প্রটোকলের সরবরাহ করা জনবলের মধ্যে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আট হাজার ৬০৫ টাকা এবং বাকি পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সাত হাজার ৭৫০ টাকা করে বেতন দিচ্ছে সরকার, যা দেওয়া হয় প্রটোকলের মাধ্যমে।
তবে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে কর্মরত এমন পাঁচজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রটোকল প্রতি মাসে তাঁদের বেতন থেকে এক হাজার টাকা কেটে নিচ্ছে। চালক ও পিয়নদের বেতন থেকেও এক হাজার টাকা করে কাটা হচ্ছে। উৎসব ভাতা দেওয়া হয় না। নিয়োগপত্রও দেওয়া হয়নি। এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে চাকরি খাওয়ার ভয় দেখানো হয়।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমরাও এসব অভিযোগ পেয়েছি। প্রতিষ্ঠানটিকে কর্মচারীদের পূর্ণ বেতন দিতে বলেছি। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ওই কর্মচারীদের বেতন দেয়। ফলে আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না। ঈদ বোনাস দেওয়া হচ্ছিল না। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে প্রটোকলকে বলেছি, কর্মীদের বোনাস দিতে। এরপর তারা বোনাস দিতে বাধ্য হয়েছে।’
জানতে চাইলে বরকত হোসেন বলেন, ‘আমি কারও বেতন কাটি না। এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। ইচ্ছা করে কেউ ষড়যন্ত্র করছে। আপনারা সেই ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের কেউ তো কখনো এমন অভিযোগ করেনি।’
অভিযোগ রয়েছে, শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) ইসহাক আলীর সঙ্গে বরকত হোসেনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তবে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি অস্বীকার করে ইসহাক আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাড়ি বরিশাল। বরকত হোসেনকে আগে চিনতাম না। তবে খুলনা পলিটেকনিকে আমি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। বরকতও অনেক আগে সেখানকার ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সেই হিসেবে তাঁর নাম জানতাম। পরে প্রতিমন্ত্রীর কার্যালয়ে আমি তাঁকে কয়েকবার দেখেছি। তাঁর বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’

No comments

Powered by Blogger.