নো ইজি ডেলাদের হত্যার প্রত্যক্ষ বয়ান-৬- লাশ নিয়ে জালালাবাদের পথে by মশিউল আলম

কথা ছিল, ৩০ মিনিটের মধ্যে অভিযান শেষ করে ফেরার পথে যাত্রা শুরু করতে হবে। কিন্তু গোটানোর কাজ শেষ হয়নি; তিনতলা বাড়িটির সব তলায় এখনো কমান্ডোরা তল্লাশি চালাচ্ছেন, ব্যাগে ভরে নিচ্ছেন লাদেনের ব্যবহূত নানা সরঞ্জাম।


নির্ধারিত ৩০ মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে জালালাবাদ থেকে অ্যাডমিরাল ম্যাকর‌্যাভেনের কাছ থেকে আরও ১০ মিনিট সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। তবু কাজ শেষ হচ্ছে না, অনেক কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে; অনেক জায়গা তল্লাশি ছাড়াই ছেড়ে আসতে হচ্ছে। ওদিকে হেলিকপ্টারের জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে, তা ছাড়া কখন পাকিস্তানি পুলিশ বা সামরিক বাহিনী এসে পড়ে, সেটাও বড় এক দুশ্চিন্তার কথা।
এ রকম অবস্থায় ম্যাক বিসোনেটের মনে হচ্ছে, ‘আমরা এসেছি লাদেনের জন্য, তাঁকে পাওয়া গেছে, ব্যস। এখন সময় ভালোয় ভালোয় ফিরে যাওয়া যাক।’ তিনি বেতারযন্ত্রে শুনতে পেলেন সহযোদ্ধা মাইকের কণ্ঠ: ‘নারী ও বাচ্চাদের একত্র করে কম্পাউন্ডের বাইরে নিয়ে যাও।’ কারণ, বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটিতে বিস্ফোরক লাগানো শেষ হয়েছে, এখনই সেটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। ম্যাটের সহযোদ্ধা উইল নারী ও শিশুদের বাইরে বের করে আনার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কোনোভাবেই সুবিধা করতে পারছেন না। নারীরা ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছেন, চিৎকার করে কাঁদছে শিশুদের কেউ, গাঁট হয়ে বসে আছে অন্যরা। নড়াচড়া করতে চাইছে না কেউ।
ম্যাট মূল ভবনের নিচতলা থেকে বেরিয়ে এলেন। লাদেনের বার্তাবাহক আরশাদ খান ওরফে আল-কুয়েতিকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে, সেই অতিথিশালার উঠোনের এক কোণে দেখতে পেলেন আল-কুয়েতির স্ত্রী ও শিশুরা উবু হয়ে বসে আছে। এই সময় ট্রুপ নেটের বেতারে বেজে উঠল সহযোদ্ধা মাইকের জরুরি ডাক: ‘তোমরা যে যা করছ, সব বন্ধ করে হেলিকপ্টারের দিকে এগোও।’ ম্যাট তাড়াতাড়ি আল-কুয়েতির স্ত্রী ও শিশুদের উঠোন থেকে তুলে অতিথিশালার ভেতরে নিয়ে গেলেন। বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের বিস্ফোরণটি হবে বিরাট, কিন্তু অতিথিশালার ভেতরে থাকলে তাঁদের আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা নেই—এটা ভেবে ম্যাট তাঁদের ইংরেজিতে বললেন, ‘এখানেই থাকো।’ তারপর বেরিয়ে এসে পেছন থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ছুটলেন; গেটের বাইরে বেরিয়ে ডানে ঘুরে চোঁ দৌড় লাগালেন সেই দিক লক্ষ করে, যেখানে অন্য কমান্ডোরা হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য জড়ো হয়েছেন। স্নাইপাররা হেলিকপ্টার নামার জায়গাটি ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন। দুটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের মধ্যে যেটি অক্ষত আছে, সেটিতে উঠবেন ম্যাক ও তাঁর দলের সঙ্গীরা, তাঁদের সঙ্গে থাকবে লাদেনের লাশ। সেটি ইতিমধ্যে ঢোকানো হয়েছে মৃতদেহ বহনের একটি ব্যাগে, কমান্ডোরা সংক্ষেপে সেটাকে বলছেন ‘বডি ব্যাগ’। বডি ব্যাগ নিয়ে তাঁরা লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন ‘ব্ল্যাক হক’ হেলিকপ্টারটিতে ওঠার জন্য। সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টারের তুলনায় এই ব্ল্যাক হক অনেক ছোট, আকাশে এটা নিয়ে কেরামতি করা যায় অপেক্ষাকৃত সহজে। বড়টার তুলনায় এতে গুলি লাগার আশঙ্কা কম। এ জন্যই এটিতে বহন করা হবে লাদেনের লাশ। বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটির কমান্ডোরাসহ অন্যরা যাবেন বড় সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টারে।
এর মধ্যে আশপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠেছে। ম্যাট দেখতে পেলেন কয়েকটি জানালায় লোকজনের কৌতূহলী মুখ। আলী নামের দোভাষী লোকটি পশতু ভাষায় চিৎকার করে লোকজনকে বলছেন ঘরে চলে যেতে। ম্যাট কমান্ডোদের মাথা গুনতে শুরু করলেন; শেষে দেখলেন উইল নামের সহযোদ্ধাটি নেই। ম্যাট ট্রুপ নেটের বেতারে উইলকে খোঁজা শুরু করবেন, এমন সময় দেখতে পেলেন, ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসছেন উইল। বডি ব্যাগের পাশে দাঁড়িয়ে ওয়াল্ট, তাঁর পাশে জায়গা নিয়ে ম্যাট দেখতে পেলেন, ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারটি নেমে আসছে তাঁদের নেওয়ার জন্য। মাটির কাছাকাছি নামতে সেটির পাখার বাতাসে ধুলো আর খড়কুটো-আবর্জনার ঝড় উঠল, কমান্ডোরা মাথা নিচু করলেন চোখ বাঁচাতে। হেলিকপ্টারটি মাটিতে থিতু হলে ম্যাট আর ওয়াল্টসহ কয়েকজন মিলে লাদেনের লাশসমেত বডি ব্যাগটি তুলে নিয়ে ছুটলেন সেটির দরজার দিকে। সদ্য লাঙল চালানো জমিতে ঢাউস এক একটা মাটির ঢেলায় হোঁচট খেতে খেতে লাদেনের ছয় ফুট চার ইঞ্চি লাশ কাঁধে নিয়ে তাঁরা শ খানেক গজ দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন হেলিকপ্টারের খোলা দরজার কাছে। লাশের ব্যাগটি হেলিকপ্টারের ডেকে ছুড়ে দিয়ে তাঁরা উঠে পড়লেন দ্রুত। এই হেলিকপ্টারে যাঁদের যাওয়ার কথা, উঠে পড়লেন তাঁরা সবাই। কিন্তু উড়ছে না ব্ল্যাক হক। একা উড়বে না সে। ম্যাটের মন্তব্য, হেলিকপ্টার ওড়ে জোড়া ফড়িংয়ের মতো। কিন্তু এর অন্য জোড়াটির দেখা নেই। সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টারটি এখনো এসে পৌঁছায়নি। অপেক্ষা করছে ব্ল্যাক হক। ম্যাট বিসোনেট ভয় পাচ্ছেন: এই বুঝি ছুটে এল একটা রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড। অথবা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হয়তো ইতিমধ্যে রওনা দিয়েছে এই বাড়ির উদ্দেশে। আশপাশে এত লোক জেনে ফেলেছে, আর ওরা খবর পায়নি, এটা কি হয়? ‘আমরা তো একটা আগ্রাসী সৈন্য বাহিনী; ঢুকে পড়েছি একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ডের ভেতরে!’
অভিযান শেষ করার জন্য বাড়তি যে ১০ মিনিট সময় নেওয়া হয়েছে, তা থেকে পেরিয়ে গেছে আট মিনিট। হেলিকপ্টারটিতে বিস্ফোরক লাগানো হয়েছে এমনভাবে যে বিস্ফোরণ ঘটবে ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে চার মিনিট। এ সময় দেখা গেল, অচল হেলিকপ্টারটি বিস্ফোরণ ঘটানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সিল সদস্যটি চিৎকার করে ডাকছেন অভিযানের কমান্ডার জের নাম ধরে। জে দাঁড়িয়ে আছেন সেই জায়গায়, যেখানে সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টারটি নামার কথা। হেলিকপ্টারটির নিরাপদ অবতরণের চিন্তায় মগ্ন জে লক্ষই করেননি, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাঁর কাছ থেকে সামান্য দূরেই ঘটতে যাচ্ছে এক ভয়ংকর বিস্ফোরণ। সিল সদস্যটি সেখানে ছুটে গিয়ে জে বললেন, ‘আর ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটবে, এই এলাকা থেকে সব হেলিকপ্টার এক্ষুনি সরিয়ে নিতে হবে। সিএইচ-৪৭-কে এখন নামতে নিষেধ করে দাও।’ জের জানা আছে, অচল হেলিকপ্টারটিতে যে বিস্ফোরণ ঘটবে, তাতে নামতে থাকা সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টার আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে যাবে ভূমিতে, আর নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে যে ‘ব্ল্যাক হক’, ধ্বংস হয়ে যাবে সেটা। জে বেতারে সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টারের চালকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন।
আর মাত্র ৩০ সেকেন্ড। ওসামা বিন লাদেনের লাশ, ম্যাট বিসোনেট ও তাঁর টিমের কমান্ডোদের নিয়ে অক্ষত ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারটি দ্রুত উড়ল আকাশে। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কাত হয়ে গতি সঞ্চার করতে লাগল সেটি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল লাদেনের বাড়ির সামনের চত্বর; বিশাল অগ্নিকুণ্ডলী উঠে এল আকাশে। সে আলোয় মুহূর্তের জন্য ঝলকে উঠল হেলিকপ্টারের কেবিন।
বিস্ফোরণের পর সিএইচ-৪৭ হেলিকপ্টারটি এসে নামে। অবশিষ্ট সব কমান্ডোসহ অভিযান দলের অন্য সবাই সেটিতে দ্রুত উঠে পড়েন। দ্রুতই সেটি আফগানিস্তানের জালালাবাদের উদ্দেশে উড়ে যায়। মার্কিন কমান্ডো দল নিয়ে যায় শুধু লাদেনের লাশ। অন্য লাশগুলো আর আহত দুই নারীসহ শিশুদের ওই বাড়িতে রেখেই তাঁরা চলে যান।
বিস্ফোরণের শব্দে পুরো অ্যাবোটাবাদ শহরই যেন মধ্যরাতে জেগে ওঠে। কৌতূহলী লোকজন বেরিয়ে আসে আশপাশের ঘরবাড়ি থেকে। খবর পেয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীও; খবর না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ওই বাড়ি থেকে মাত্র এক মাইলের মধ্যেই বিশ্ববিখ্যাত পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমি; আর পুরো অ্যাবোটাবাদ শহরটাকেই বলা হয় সেনাদের শহর। মার্কিন কমান্ডোদের নিয়ে হেলিকপ্টারগুলো পাকিস্তানের আকাশসীমা পেরিয়ে আফগানিস্তানের আকাশে ঢোকার আগেই ৩০ মিলিমিটার ক্যানন শেল আর এয়ার-টু-এয়ার মিসাইলে সজ্জিত পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর দুটি এফ-১৬ জঙ্গি বিমান পাকিস্তানের আকাশ চিড়ে ছুটে যায় অ্যাবোটাবাদের দিকে।
এ খবর অবশ্য ম্যাট বিসোনেট বা তাঁর সহযোদ্ধারা পাননি; জালালাবাদমুখী হেলিকপ্টারে বসে তাঁরা বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছেন। ৩০ মিনিটের অভিযান শেষ করতে লেগেছে ৩৮ মিনিট। একটি হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে বটে, কিন্তু হতাহত হননি একজনও। আকাশে হেলিকপ্টারের কেবিনেও অন্ধকার। শুধু আলো জ্বলছে ককপিটের ড্যাশবোর্ডে। আর ম্যাট দেখতে পাচ্ছেন কনসোলে কয়েকটি মিটারের আলো, জ্বালানির মিটারটিও আছে ওই সারিতে। ম্যাট লক্ষ করলেন, জ্বালানির মিটারটিতে লাল রঙের আলো জ্বলছে আর নিভছে। পাইলট না হয়েও তিনি জানেন, হেলিকপ্টারের ককপিটে এ রকম লালবাতি জ্বলা আর নেভার অর্থ ভালো কিছু নয়।
৩৮ মিনিট আগে ম্যাট ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে একটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার অ্যাবোটাবাদে লাদেনের বাড়ির দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে লাদেন শিকার অভিযান সমাপ্ত হয়েছে, এবার কি দ্বিতীয় ব্ল্যাক হকও কোনো বিপদে পড়তে চলেছে?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.