ভর্তি পরীক্ষার বিড়ম্বনা ও সহজীকরণ by ড. মো. খালিদ হোসেন

আমার মেয়ে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে অবস্থিত উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। আর দশজন অভিভাবকের মতো আমারও ইচ্ছা ছিল তাকে মেয়েদেরই স্বনামধন্য স্কুল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অথবা হলিক্রস হাই স্কুলে ভর্তি করাব।


প্রতিবেশী অধিকাংশ সহকর্মীর মেয়েরা ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ায় আমার মেয়েরও শখ ছিল সেখানে পড়ার। তাই প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির সময় মেয়েকে ওই দুটি স্কুলের যেকোনো একটিতে ভর্তি করার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। দুটি স্কুলেই প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও চূড়ান্ত বাছাইটি লটারিতে হওয়ায় সেখানে আমার মেয়ের নামটি ওঠেনি। তাই ওই দুই স্কুলের যেকোনো একটিতে মেয়েকে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হলাম। মেয়ে যখন আমাকে জিজ্ঞেস করল, আব্বু আমি কেন ওখানে ভর্তি হতে পারলাম না? তখন বলেছিলাম- 'মা তুমি পরীক্ষায় ভালো করেছ; কিন্তু লটারিতে তোমার নাম ওঠেনি।' উত্তরটি আমি সহজভাবে দিলেও তার জন্য এটি বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তাই তার মনের মধ্যে একটি ধারণা জন্মেছিল যে সে বোধ হয় ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি। যা-ই হোক, এ বছর উদয়ন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর আমার মেয়ে বাসায় এসে বলল, আব্বু আমি প্রথম হয়েছি। তখন সুযোগ বুঝে মেয়েকে বললাম, 'মা, বলেছিলাম না তুমি ভালো ছাত্রী। কিন্তু লটারির কারণেই ভিকারুননিসায় বাদ পড়েছিলে।' একটি দৈনিকে গত ২৪ আগস্ট হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারিক আদনান, ২৬ আগস্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার ও ২৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষক সৌরভ শিকদারের যে লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও এর ফলাফল মূল্যায়নের যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তার প্রেক্ষাপটে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের যৌক্তিক কারণগুলো বর্ণিত হয়েছে। শুধু জিপিএ দিয়ে মেডিক্যালে ভর্তির যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে গেলে সমান জিপিএপ্রাপ্ত সব ছাত্রছাত্রীকেই মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ দিতে হবে।
একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে দেশের সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির যোগ্য প্রার্থী খুঁজে বের করাটা যৌক্তিক নয়। কারণ মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের কৌশল এক রকম নয়। তাই কয়েকটি ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির বিষয়টি সহজে সুরাহা করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ সব মেডিক্যাল কলেজ মিলে যেভাবে একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেভাবে একটি মাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট, আইইউটি, রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট ও বাংলাদেশ টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয়) ও প্রকৌশল কলেজে ভর্তির জন্য যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা যেতে পারে। অন্যদিকে একটি মাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আবার দেশের সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি কলেজ একই পথ অনুসরণ করতে পারে। অর্থাৎ মাত্র পাঁচটি ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী ভর্তির প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যেতে পারে।
সমন্বিত পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তি এ জন্য যে তাদের আয় কমে যাবে। এ ধারণাটিও সঠিক নয়। কারণ সমন্বিত পরীক্ষা হলেও একজন ছাত্র যে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যোগ্যতা যাচাই করতে চায়, সে ততটির জন্য ধার্য টাকা দিতে আপত্তি করবে না। যেহেতু সমন্বিত পরীক্ষা গ্রহণের ফলে একজন ছাত্রের সামগ্রিক খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক- BUET, IUT, RUET, KUET, CUET এবং BTU-এর জন্য BUET-এর তত্ত্বাবধানে ঢাকায় একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হলো। এ ক্ষেত্রে একজন ছাত্র যদি এর সব কয়টিতেই তার যোগ্যতা যাচাই করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, তাহলে সে এর প্রতিটির জন্য নির্ধারিত আবেদন ফি পরিশোধ করলেও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথকভাবে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার বিড়ম্বনা ও বিশাল অঙ্কের খরচ থেকে অব্যাহতি পাবে। এ পর্যন্ত প্রচলিত পদ্ধতিতে রংপুরে (ধরা যাক) অবস্থানরত একজন ছাত্রকে আলাদাভাবে ওই ছয়টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলে ভর্তি পরীক্ষার ফি বাবদ আনুমানিক তিন হাজার টাকা ছাড়াও যাতায়াত ও খাওয়া বাবদ আনুমানিক খরচ হতো ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আর একজন ছাত্রীর ক্ষেত্রে তার অভিভাবকসহ খরচ হতো আনুমানিক ৫০ হাজার টাকা। অথচ একটি মাত্র পরীক্ষা দিয়ে ওই ছয়টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ হলে রংপুরে অবস্থানরত ওই ছাত্রের ভর্তি ফির সঙ্গে যাতায়াত ও খাওয়া বাবদ খরচ হবে আনুমানিক দুই হাজার টাকা আর একজন ছাত্রীর অভিভাবকসহ খরচ হবে মাত্র চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা বিভিন্ন রকম হলেও তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মেধা যাচাই করা সম্ভব।
ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনেক সময় অহেতুক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। যেমন- BUET-এ ভর্তির ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে এইচএসসিতে পদার্থ, গণিত ও রসায়নে A+ (সর্বোচ্চ গ্রেড) পাওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া সমীচীন হলেও শুধু আবেদনকারীর সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে A+ পাওয়ার আবশ্যকতা যুক্তিযুক্ত নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভর্তীচ্ছু ছাত্রছাত্রীরা কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণসাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে। পরবর্তী সময়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্টসংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে তাদেরই নির্ধারিত ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। অথচ বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষায় আবেদনের টাকাও ফেরত দেয় না। এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শোভনীয় নয় বলে আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার অধিকারী সব ছাত্রছাত্রীকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করতে হবে অথবা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর তালিকা প্রকাশের পর কেবল তাদের কাছ থেকেই ভর্তি পরীক্ষার আবেদনের ফি গ্রহণ করতে হবে।
আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ফলে একই ছাত্র বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের ভর্তিকৃত ছাত্রছাত্রীদের বারবার মাইগ্রেশনের মাধ্যমে বিভাগ পরিবর্তন করার সুযোগ করে দিতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু আসন শূন্য থেকে যায়। সমন্বিত পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হলে এ সমস্যারও অনেকটা সমাধান হবে।
তাই আমার সর্বশেষ অভিমত হলো, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তির আগের নিয়ম বহাল রেখে সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল কলেজগুলোর জন্য BUET; পুরনো বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর জন্য ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা সহজীকরণ এবং ভর্তি পরীক্ষার বিড়ম্বনা নিরসন করার অগ্রযাত্রা শুরু করা যেতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করতে পারে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.