গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দীপু মনির কাছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ব্যাপারে বিবৃতি দেওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে সরাসরি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনে গত বুধবার সকালে (বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত সাড়ে ৮টা) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে এক বৈঠকে দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম জোসেফ বার্নস দীপু মনির কাছে এ উদ্বেগের কথা জানান।


তওই দিনই আরেক বৈঠকে প্রস্তাবিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা কাঠামো চুক্তি (টিকফা) নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আরো আলোচনা করতে সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্কহার কমানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য টিকফা স্বাক্ষরের শর্ত দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীপু মনির বৈঠক প্রসঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস প্রকাশিত 'মিডিয়া নোট'-এ বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্নস বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে পররাষ্ট্র দপ্তরে সাক্ষাৎ করেন।
মিডিয়া নোটে বলা হয়, উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্নস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনি গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যকারিতা ও অখণ্ডতা বজায় রাখা এবং বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুশীল সমাজ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। বার্নস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা দীপু মনিকে জানান। তাঁরা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা করেন।
মিডিয়া নোটে আরো বলা হয়, বার্নস আফগানিস্তান বিষয়ে বাংলাদেশের সমর্থন এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সহযোগিতা বৃদ্ধি ও যোগাযোগ প্রসারে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার অংশীদারিকে স্বাগত জানান।
উল্লেখ্য, গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নতুন না হলেও এবার ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে সরাসরি উদ্বেগের কথা জানানো হলো। এর আগে ওয়াশিংটন এ ইস্যুতে কয়েক দফা বিবৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যকারিতা ও অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও নারী সিনেটররা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন যে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধনের ফলে এর গ্রাহকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, তেমনি ব্যাংকের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা কমবে না।
অন্যদিকে আফগান ইস্যুতে বর্ধিত পরিসরে সহযোগিতার ব্যাপারে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা চলছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। দুই বছর আগে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের জন্য সেনা চাইলেও বাংলাদেশের এ ব্যাপারে অনীহা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ আফগানিস্তান পুনর্গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করে, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে বাংলাদেশের উদ্যোগের প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এক ঘণ্টার ওই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন, জ্বালানি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রভৃতি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দীপু মনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার বাংলাদেশসহ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যের সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বার্নস বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টিকফা চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, এ চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্কহারের বিষয়টির পুনর্বিবেচনা সম্ভব হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারেও আশ্বাস দেন বার্নস। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে যাতে তাঁর শাস্তি হয়- এ কথাও বলেন যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বৈঠকে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে বার্নস বলেন, গত মে মাসে ঢাকা সফরের সময় হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, এ ব্যাপারে দুই দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আরো কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন দীপু মনি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠানটির নারী ঋণগ্রহীতার স্বার্থ সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। গ্রামীণ ব্যাংক আইন ও বিধি অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এ মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারি সংলাপের সফলতার আশাবাদও ব্যক্ত করেন এই দুই নেতা।
বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রবার্ট ও'ব্লেক এবং দুই দেশের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তা।
রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, টিকফা নিয়ে আলোচনা করতে যুক্তরাষ্ট্র আবারও রাজি হয়েছে। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ কথা জানানো হয়। টিকফা নিয়ে আলোচনার জন্য মাইকেল ডিলানি শিগগির বাংলাদেশ সফরে করতে পারেন বলে তিনি জানান।
রাষ্ট্রদূত বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ও জিএসপি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের কর্মীদের অবস্থা ও সামগ্রিক পরিস্থিতির ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
টিকফা চুক্তি নিয়ে চার বছর ধরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে সম্প্রতি এ নিয়ে অচলাবস্থা দেখা দেয়। পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস গত জুলাই মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা সইয়ে অচলাবস্থার জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। এ নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশ সব সময় প্রস্তুত। তিনি মন্তব্য করেন, 'আপনি কাগজ নিয়ে এসে বললেন, আলোচনার সময় নেই, এটাতে সই করতে হবে। এটা তো হতে পারে না।'
এদিকে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে উদ্বেগ থাকলেও বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে চমৎকার অভিহিত করেছেন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাবি্লউ মজিনা। গত সোমবার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম পরিদর্শনকালে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক সত্যিকার অর্থেই চমৎকার। তবে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছে।
টিকফা স্বাক্ষর প্রশ্নে মজিনা বলেন, এটা হলে ভালো হবে কি হবে না, তা বাংলাদেশকেই ভেবে দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হলো, টিকফা স্বাক্ষরিত হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বাধাগুলো দূর করার জন্য আলোচনার সুযোগ হবে।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৩০ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে। গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শ্রমমান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে। আগামী ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারি সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের ওই আলোচনায় এসব ইস্যু উঠে আসবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

No comments

Powered by Blogger.