বুয়েট শিক্ষকরা ক্লাসে যাবেন অনাস্থা নিয়ে-ভিসির অপসারণ দাবিতে শিক্ষার্থীরা অনড়

উপ-উপাচার্যকে সরিয়ে নেওয়া এবং চুরির মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পরও বুয়েট সংকট কাটছে না। নতুন করে শিক্ষার্থীরা উপাচার্য অপসারণের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়ে বলেছেন, উপাচার্য অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ক্লাসে যাবেন না। গতকাল মঙ্গলবার বুয়েট অডিটোরিয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা এ দাবি জানান।
অন্যদিকে শিক্ষক সমিতি উপাচার্যের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ক্লাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুরকৌশল ভবনের সামনে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান ক্লাসে যাওয়ার বিষয়টি জানান।
বুয়েটে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন শুরুর সময় শিক্ষার্থীরা সরাসরি অংশ নেননি। কিন্তু গতকাল তাঁরা উপাচার্য অপসারণের দাবিতে একাট্টা হয়েছেন।
গত এপ্রিলে শিক্ষক সমিতি উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের ছয় মাসের মাথায় গত সোমবার রাতে শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকের পর শিক্ষকরা আশ্বস্ত হন। এমনকি শিক্ষকরা আন্দোলনও স্থগিত করেন। গতকাল মঙ্গলবার শিক্ষক সমিতি উপাচার্য অপসারণের দাবি নিয়ে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শিক্ষার্থীরা বলছেন, উপাচার্যকে অপসারণ না করলে ক্লাসে যাবেন না।
ঠিক কী কারণে শিক্ষার্থীরা এখন এক দফা দাবি আদায়ে অনড় অবস্থানে রয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র সুদীপ্ত সাহা সাংবাদিকদের বলেন, 'শিক্ষকরা মন্ত্রীর বক্তব্যে আশ্বস্ত হলেও আমরা আশ্বস্ত হতে পারিনি। আমরা উপাচার্যেরও অপসারণ চাই।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্লাসে ফিরে যাওয়া নিয়ে শিক্ষক সমিতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদের দিয়ে উপাচার্য অপসারণের দাবি সামনে নিয়ে এসেছে। আর শিক্ষকদের আরেকটি অংশ 'ক্যারিয়ার ও বিদেশ' যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার জন্য আপাতত ক্লাসে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। শিক্ষকদের এই বিভক্তি ধরা পড়ে শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলনের সময়। শিক্ষার্থীরা যখন সংবাদ সম্মেলন করেন, তখন শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর উপস্থিত ছিলেন। এই উপস্থিতি সম্পর্কে ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীদের ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছি। আর শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান বলেন, শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তি ঘটেনি। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছেন।'
এদিকে শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়েছে, 'শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয় পক্ষই একতাবদ্ধ রয়েছে। যেকোনো সিদ্ধান্ত উভয় পক্ষ একসঙ্গে নেবে, এ বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত ছিলাম এবং আছি। এ জন্য উপাচার্য অপসারণের কথা আমরা সরাসরি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে জানাতে চাই।'
শিক্ষার্থীদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সোমবার রাতে শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষকরা আশ্বস্ত হয়েছেন। এখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর শিক্ষার্থীরা যদি আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান, করতে পারবেন। আমরা চাই বিষয়টির একটি সমাধান হোক।'
শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, আজ বুধবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বুয়েট কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। উপ-উপাচার্যকে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার পরও ক্লাসে না যাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সিনিয়র শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখবেন।
শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন : গতকাল বিকেল ৪টার দিকে বুয়েট মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, 'শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার ওপর তাঁদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বুয়েটের শিক্ষার্থী মেরিনা জামান। এতে বলা হয়, বুয়েট চলমান আন্দোলনে এক দফা এক দাবি ভিসি ও প্রোভিসির অপসারণ। আমাদেরকে যাঁরা চুরির দায়ে মিথ্যা মামলা দেন, আমাদের তাজা রক্ত দেখেও যাঁদের হৃদয়ে বিন্দুমাত্র কম্পনের সৃষ্টি হয় না, তাঁদের একজনেরও এই প্রাঙ্গণে অবস্থান আমাদের জন্য নিরাপদ নয় বলে বিশ্বাস করি। এ অবস্থায় আমরা উপাচার্যকে তাঁর পদ থেকে সরে যেতে অনুরোধ করছি।'
বক্তব্যে আরো বলা হয়, আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে শিক্ষার্থীদেরও নিজস্ব ভাবনা রয়েছে। রয়েছে নিজেদের যুক্তিসংগত ভাবনাগুলো তুলে ধরার চেতনা। তাই অভিভাবক হিসেবে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তাঁরা তাঁদের কথাগুলো তুলে ধরতে চান। এ সময় শত শত শিক্ষার্থী উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে না সরানো পর্যন্ত ক্লাসে যাবেন না বলে চিৎকার করে জানাতে থাকেন। বুয়েটের এই আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই বলেও লিখিত বক্তব্যে বলা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দুজন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের একজন অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, 'শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দাবি অভিন্ন- উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অপসারণ। সরকারও তা উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে আমরা মনে করি। এ জন্য গত সোমবার রাতে শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর উপ-উপাচার্যকে প্রত্যাহার এবং কর্তৃপক্ষের করা মামলা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। উপাচার্যের বিষয়ে বলা হয়েছে, আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে। তবে শিক্ষার্থীরা চান, এখনই উপাচার্যকে সরানো হোক। আমরা আলোচনায় আছি। আমরা মনে করি, আলোচনার মাধ্যমে শিগগিরই একটা সুষ্ঠু সমাধান পাওয়া যাবে।'
শিক্ষক সমিতির ক্লাসে ফেরার ঘোষণা : শিক্ষকরা সোমবার রাতে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত গতকাল সকালে শিক্ষার্থীদের জানান। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা তাঁদের আপত্তির কথা শিক্ষকদের জানান। বর্তমান উপাচার্যের অধীনে তাঁরা নিরাপদ নন উল্লেখ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে আরেকটি বৈঠকে করেন। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে দাবিগুলো জানান শিক্ষার্থীরা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার মধ্যরাতে বুয়েট শিক্ষক সমিতির নেতারা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করেন। রাত দেড়টার দিকে বৈঠক শেষ হয়। বৈঠকে বুয়েটের উপ-উপাচার্য হাবিবুর রহমানকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা কর্তৃপক্ষের মামলা প্রত্যাহারেরও সিদ্ধান্ত হয়।
শিক্ষক সমিতির বৈঠক শেষে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছে সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিক্ষকরা ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁরা উপাচার্যের অপসারণের দাবি থেকে সরে আসেননি। আলোচনার মাধ্যমেই এ বিষয়টির সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। উপাচার্য অপসারণের দাবি রেখেই ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষকরা। তিনি জানান, বুধবার শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিবের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিয়েই আলোচনা হবে। তবে কোথায়, কখন আলোচনায় বসা হবে সেটি জানাতে পারেননি তিনি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'এটা শিক্ষার্থীদের বিষয়। শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিবের সঙ্গে আলোচনা করেই সমাধানে পেঁৗছানো যাবে বলে আমরা আশা করছি।' শিক্ষকরা নীতিগতভাবে ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এর জন্য কিছু প্রস্তুতি লাগবে। অনেক দিন ক্লাস বন্ধ থাকায় নতুন একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরি করতে হবে। এ জন্য দিন দুয়েক সময় লাগবে।

No comments

Powered by Blogger.