কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-বিষয় তফাতকেন্দ্রিক by রণজিৎ বিশ্বাস

এক ক্লাসরুম সহপাঠী আছে আমার, যাঁর প্রশ্ন বড় উদ্ভট উদ্ভট। প্রশ্নগুলো পাঠান তিনি মোবাইল ফোনের টেঙ্ট মেসেজে। যেমন- ফুল ও পাখির মধ্যে পার্থক্য কী? যেমন- নলেজ ও এজিলিটির মধ্যে কী পার্থক্য? প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুরোধও পাঠান- জবাব চাই কিন্তু।


তিনি জানেন, জবাবও হবে উদ্ভট প্রকৃতির। তিনি সেগুলো আবার আড্ডায় আড্ডায় শেয়ারও করেন। বলেন- দেখো, তোমাদের শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিকের জবাব দেখো; তার পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দেখো।
খুব চিন্তা করে আমি জবাব দিই না। সেকেন্ডের ভাবনায় যা-ই আসে, এসএমএসএ তা-ই বসে। যেমন- ফুল ও পাখির বেলায় আমি বলেছিলাম, পুঁইশাক ও সজনে ডাঁটায় যে পার্থক্য, এখানেও সে পার্থক্য; নলেজ ও এজিলিটির বেলায় বলেছি- একটি ব্রিঞ্জেল, অন্যটি নড্যুলাস বিন। একটি বর্তাকু অন্যটি বরবটি।
তিনি আমাকে নলেজ ও এজিলিটিবিষয়ক যে দুটো পুরনো কৌতুক আছে, সেদিকে নিতে চেয়েছিলেন। আমি যাইনি। ভয়ে। তাঁকে উৎসাহ দিলে তিনি এমন সব কৌতুক পাঠিয়ে ব্যস্ত রাখবেন, যা সব জায়গায় বলাও যায় না, সব আসরে শোনাও যায় না; আবার আসর উপযুক্ত হলে তা থেকে সরানোও যায় না।
নলেজের কৌতুকটি আমরা কলেজে পেয়েছিলাম এজিলিবিটি ভার্সিটিতে। বিয়ের পাত্রের নলেজ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রফেশনাল ম্যাচ-মেইকারের কাছে। অপরিচিত শব্দটির তিনি যা মানে ধরে নিয়েছিলেন এবং ধারণামতো জবাব দিয়েছিলেন, সে বড় অদ্ভুত। অদৃশ্য বিষয়টিকে তিনি দৃশ্যমান কোনো প্রত্যঙ্গের জায়গায় বসিয়ে তাঁর ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে সেরে এসেছিলেন।
এজিলিটির ব্যাপারটি একটি ভিন্নরকম। শৌখিন এক ঘোড়সওয়ারি- এটি অনেকে অনেকভাবে বলেন, অনেক রেসিপিতে রাঁধেন, আমি সাজাতে চাই অশ্বচালনার সঙ্গে যুক্ত করে।
ঘোরসওয়ারি চাইলেন, তাঁর গৃহকর্ত্রীও যেন কাজটি শিখে নেয়। একদিন অ্যাসিস্ট্যান্টকে নিয়ে তিনি কাজটি শুরু করলেন। স্মার্ট ভদ্রমহিলা প্রথম চেষ্টায়ই ঘোড়ার পিঠে চেপে তাঁকে দাবড়ে নিলেন। স্বামীটি তাঁর সহকারীর কাছে জানতে চাইলেন- দ্যাখা! তুম মেরা বিবিকো এজিলিটি দ্যাখা? অ্যাসিস্ট্যান্ট বলল- নো স্যার। দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও একই সাফল্য, একই প্রশ্ন ও একই উত্তর- নো স্যার, নেহি দ্যাখা। কিন্তু ট্রেইনার প্রশ্নের জবাব নিয়েই ছাড়বেন। চতুর্থবার ক্লান্ত প্রশিক্ষণার্থিনী ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলেন। বড় বিস্রস্ত অবস্থায়। প্রাইভেট পার্টসের কোনো ঠিকঠিকানা থাকল না। এবারও তিনি হুঙ্কার দিলেন- দ্যাখা, দ্যাখা তুম মেরা মিসেসকো এজিলিটি? অ্যাসিস্ট্যান্ট এবার লাজে-সঙ্কোচে-নম্রতায় জবাব দিল- দ্যাখা স্যার, ইসমরতবা দ্যাখা। বহত খুউব।
কখনো কখনো তাঁর প্রশ্ন বড় বেশি নারীনির্ভর। জবাব দিতে আমার তেমন অসুবিধে হয় না। কারণ, বিষয়টি আমারও চর্চাভুক্ত।
একদিন জিজ্ঞেস করলেন- রমণী ও ডাকটিকিটের মধ্যে তফাত কী?
কৌতুকের বই আমার ঘাঁটা ছিল। বললাম- ফিমেইল ও মেইল-ফি।
: উইমেন ও ডিপ্লোম্যাটের মধ্যে পার্থক্য কী?
: প্রথম পক্ষকে ডিপ্লোম্যাসি শিখতে হয় না, দ্বিতীয় পক্ষকে প্রচুর শিখতে হয়।
: আর কোনোভাবে বলতে পারেন?
: উইমেন না দিয়ে শুরু করে এবং হ্যাঁ কখনো বলে না; ডিপ্লোম্যাট হ্যাঁ দিয়ে শুরু করে, না কখনো বলে না।
ওর আরেক প্রশ্ন; উইম্যান ও বাইসাইকেলের মধ্যে পার্থক্য কী? জানার পরও জবাব দিইনি, কারণ তাকে একই বিষয়ে আরো প্রশ্ন করায় উৎসাহিত করা হতো। তিনি আমার কাছে 'ম্যাসেজ' ও 'মাসাজ'-এর পার্থক্য জানতে চান। একই ভয়ে জবাব দিইনি।
তার সর্বশেষ প্রশ্নটি হচ্ছে- কারওয়ান বাজারে দুপুর দেড়টায় এক কেজি কৈ মাছের দাম তিন শ টাকা হলে সন্ধ্যে ৭টায় হাতিরপুল বাজারে দুই কেজি শিং মাছের দাম কত? আমার জবাব ছিল, সকাল ৯টায় পলাশী বাজারে এক কেজি পটোলের দাম ৩৫ টাকা হলে সকাল ১১টায় কাপ্তানবাজারে দেড় কেজি ঝিঙার দাম যত, ঠিক তত।
আমার জবাব ওর কখনো পছন্দ হয়নি। কিন্তু ওর একটি জবাব আমার খুব ভালো লেগেছে।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- ট্রেইন ও ক্লাসিক্যাল মিউজিকের মধ্যে তফাত কী? তিনি বলেছিলেন- প্রথমটি লেইট করতে করতে মেকআপ করে, পরেরটি মেকআপ করতে করতে লেইট করে।
তবে প্রশংসা আমি করিনি। কারণ আমরা প্রশংসায় সংযত, সমালোচনায় কঠোর। এখানেই অন্যদের সঙ্গে আমাদের তফাত।
লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.