সংসদ উত্তপ্ত-বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে আনার দাবি

স্পিকারের রুলিংকে অকার্যকর ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় নিয়ে আলোচনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে জাতীয় সংসদ অধিবেশন। স্পিকারের রুলিং সম্পর্কে রায় দিয়ে বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন ও শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে দাবি করেছেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের সংসদ সদস্যরা।


তাঁরা বলেছেন, সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চাইলে ঐক্যবদ্ধভাবে সংবিধানে বিলুপ্ত 'ইমপিচমেন্ট' বা অভিশংসনসংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনতে হবে। এ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে আনার দাবি জানান সংসদ সদস্যরা।
গতকাল মঙ্গলবার চতুর্দশ সংসদ অধিবেশনের প্রথম দিনে স্পিকারের দেওয়া রুলিংকে বেআইনি আখ্যায়িত করে হাইকোর্ট আবার রায় দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে পয়েন্ট অব অর্ডারে সরকারি দল ও জোটের সংসদ সদস্যরা এই দাবি জানান। তাঁরা সংসদকে সার্বভৌম আখ্যায়িত করে বলেন, স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতিদের মন্তব্য ও রায় সংসদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করেছে। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁরা স্পিকারের রুলিংকে বেআইনি ঘোষণা করে দেওয়া রায়কেই মনগড়া বলে মন্তব্য করেন।
উত্তপ্ত এ আলোচনা শেষে রাত পৌনে ১০টায় স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট ভেবেচিন্তে এ বিষয়ে সংসদের সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেন। তিনি বলেন, 'হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত দেব, তা সম্ভব নয়। ৩৫০ জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে এ সংসদ গঠিত। এ সংসদের প্রকৃত মালিক জনগণ। তাই চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত জানাব।'
সরকারি দলের সদস্যরা সর্বশেষ রিট গ্রহণকারী ও রায় প্রদানকারী বিচারপতিদের পাশাপাশি আগে স্পিকার সম্পর্কে 'অশালীন' মন্তব্যকারী বিচারপতির কড়া সমালোচনা করেন। তাঁরা তাঁকে অপসারণ করার দাবি জানান।
এ বিষয়ে সরকারি দলের সিনিয়র সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু, জাসদের মইন উদ্দিন খান বাদলসহ বেশ কয়েকজন বক্তব্য দেন।
আইন প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি সাব-জুডিস আখ্যায়িত করে আলোচনার সময় বিষয়টি মাথায় রাখার পরামর্শ দিলে স্পিকার তা খণ্ডন করে বলেন, 'এটি মোটেও সাব-জুডিস বিষয় নয়। সংবিধান নিয়ে আলোচনা। তাই সাব-জুডিস পর্যায়ে আলোচনা করার প্রশ্নই আসে না।'
শেখ ফজলুল করিম সেলিম শুরুতেই পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে বলেন, 'স্পিকারের ওপর উদ্দেশ্যমূলক ও নগ্নভাবে হামলা করা হয়েছে। এই হামলা স্পিকারের ওপর নয়, এটা সংসদের ওপর, গণতন্ত্রের ওপর। এ ব্যাপারে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।' তিনি গত ৫ জুন স্পিকারের ব্যাপারে এক বিচারপতির মন্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'ওই বিচারপতি স্পিকারকে অসম্মান করেছেন, তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন।' এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী স্পিকারের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি মীমাংসায় তাঁর সহায়তা কামনা করেন। পরে স্পিকার গত ১৮ জুন একটি রুলিং দেন। শেখ সেলিম স্পিকারের রুলিংয়ের বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, 'এই রুলিং সব মহলে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত হয়েছে। এই রুলিংয়ের মাধ্যমে বিষয়টির মীমাংসা হয়। কিন্তু হঠাৎ করে একটি রিট হলো। আর দুই বিচারপতি সংবিধান বহির্ভূতভাবে সেটা গ্রহণ করেন, তাঁরা মনগড়া রায় দেন। তাঁরা স্পিকারের রুলিংকে বেআইনি বলে রায় দিয়েছেন।'
শেখ সেলিম এসব ঘটনাকে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পড়ে শোনান। তিনি স্পিকারের রুলিংয়ের ব্যাপারে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেন।
একজন বিচারপতির প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'তিনি নিজেই বাদী, নিজেই বিচারক। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে বিচার বিভাগ সম্পর্কে মানুষের আস্থা থাকবে না। একজন বিচারককে কেন্দ্র করে সংসদে যে আলোচনা হয়েছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যে রায় দেওয়া হয়েছে, তাতে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে।' তিনি স্পিকারের রুলিং সম্পর্কে দেওয়া পর্যবেক্ষণকে বেআইনি আখ্যায়িত করে দেওয়া রায় সম্পর্কে বলেন, এই রায় অনেককে হতবাক করেছে, হতাশ করেছে। ওই দুই বিচারপতি এই রায় লেখেননি, অন্য কারো লেখা এই রায়- এমনটি অনেক আইনজীবী মনে করেন বলেও মন্তব্য করেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, 'এই সংসদকে সার্বভৌম করতে চাইলে আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে বাহাত্তরের সংবিধানের ইমপিচমেন্ট বিধান ফিরিয়ে আনি। তাহলেই কেবল সংসদের সার্বভৌমত্ব ফিরে আসবে।'
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, 'সংসদের যে সেন্টিমেন্ট, তার সঙ্গে আমরাও একমত। এ জন্যই আমরা আপিল করেছি।'
মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ধারাটি বিচার বিভাগের অনুকূলে থাকায় তারা সেটা বাতিল করেনি। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নেই। এই ক্ষমতা সংসদের।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'স্পিকারের রুলিংয়ের বিরুদ্ধে দেওয়া এ রায় উসকানিমূলক, উদ্দেশ্যমূলক ও দুরভিসন্ধিমূলক। এটি মীমাংসায় সাংবিধানিক সমাধানে আসতে হবে। পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, আপনার রুলিংয়ের ভিত্তি আছে এবং এখনো বলবৎ আছে। এটা না থাকলে সংবিধান থাকে না, রাষ্ট্র থাকে না। বিচারপতিরাও থাকেন না। এ রুলিংয়ের পক্ষে আমরা আছি, দেশ আছে, জনগণ আছে।'
অভিযুক্ত বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছে; তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কন্টেন্ট প্রসেডিং শুরু করা হোক। তিনি সংবিধানের ৯৬ ধারা (বিচারপতিদের ইম্পিচমেন্ট করার সংসদের ক্ষমতা) পুনর্বহালের জোর দাবি জানান।
জনগণ ও সংসদের সার্বভৌমত্ব শক্তিশালী করতে সংবিধানের ৯৬ ধারা পুনর্বহালের দাবি করে হাসানুল হক ইনু বলেন, বিচারপতিরা আইনের উর্ধ্বে নন। সংবিধানেই তাঁদের জবাবদিহির কথা বলা রয়েছে। সংসদের আলোচনা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে। সংসদের ভেতরের আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে আদালত কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। সংসদের আলাদা মর্যাদা আছে; যা নির্বাহী বিভাগ ও আদালতের নেই। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোনো দেশে সংসদের কার্যক্রমের ওপর আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

No comments

Powered by Blogger.