জিহাদ থেকে কারাগার by রবার্ট ফিস্ক

এই প্রথমবারের মতো সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের মিলিটারি কারাগারে কোনো পশ্চিমা সাংবাদিককে ঢুকতে দেওয়া হলো। তাঁরা একজনের পেছনে আরেকজন কক্ষে প্রবেশ করতে থাকলেন। মাথা নিচু করে হাত দুটো সামনে ক্রস করে রাখা, যেন হাতে হ্যান্ডকাফ পরে আছেন।


সিরিয়ার অন্যতম ভয়ানক কারাগারে বসে তাঁরা ব্যতিক্রমী কাহিনী বর্ণনা করলেন, কিভাবে সশস্ত্র বাশার আল আসাদবিরোধীদের সহায়তা করেছেন। তাঁদের একজন আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ফরাসি নাগরিক। ছোটখাটো, বছর চলি্লশেক বয়সের লোকটি সামনের দিকে ঝুঁকে আছেন। মুখে লম্বা দাড়ি। আরেকজন তুর্কি। কালো চোখ। তিনি বললেন, তাঁর প্রশিক্ষণ হয়েছে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে তালেবান ক্যাম্পে। একজন সিরিয়ান বন্দি বর্ণনা করলেন কিভাবে দামেস্কের কেন্দ্রস্থলে দুটি রক্তক্ষয়ী আত্মঘাতী বোমা হামলায় তিনি সহায়তা করেছেন। আরেকজন হলেন মুফতি। তিনি সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত উপদলগুলোকে একত্র করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।
এই প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া সিরিয়ার কারাগারে প্রবেশ করতে দিলে আমরা চারজনের সঙ্গে মিলিত হই। দেখলাম, তাঁদের সাক্ষাৎকার ছিল শীতল এবং স্থির ঠাণ্ডা মাথার। দুজন কায়দা করে ইঙ্গিতে প্রথম গ্রেপ্তার হওয়ার সময় যে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তা জানিয়ে দিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সময় কারাগারের সেনা কর্তৃপক্ষে সরে যেতে ১০ মিনিট সময় লেগে গেল। অবিশ্বাস্যভাবে তারা আমাদের একা ছেড়ে দিল বন্দিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। পরে সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে সাক্ষাৎকারের কপি চাইলে আমরা তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি।
বন্দিদের দুজন জানালেন ইসলামিস্ট শিক্ষকরা কিভাবে তাঁদের রিক্রুট করেছেন। অন্যজন বর্ণনা করলেন কিভাবে আরবের একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল তাঁকে সিরিয়ায় গিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। এটা পরিষ্কার যে সিরিয়া সরকার চাচ্ছিল এই কাহিনীগুলো আমাদের শোনাতে। কিন্তু বন্দিরা যে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় উদ্বিগ্ন ছিলেন, সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ফরাসি নাগরিক আমরা যে মুরগি ভাজা ও চিপসের বাক্স দিয়েছি, তা গোগ্রাসে ভক্ষণ করলেন। একজন সিরিয়ান জানালেন, এই বন্দিকে একা একটি সেলে রাখা হয়েছে। আমরা চারজনই প্রতিশ্রুতি দিলাম যে তাঁদের নাম-ঠিকানা-বৃত্তান্ত আমরা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের হাতে তুলে দেব।
মোহাম্মদ আমিন আলী আল আবদুল্লাহর বয়স ২৬ বছর। তিনি মেডিক্যালের চতুর্থ বছরের ছাত্র। লাটাকিয়া এলাকার একটি সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে। তিনি জানালেন তাঁর মানসিক সমস্যার কথা। কথা বলার সময় দুবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। একজন মেডিক্যালের ছাত্র হিসেবে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি মনস্তাত্তি্বক সহায়তাও নিয়েছিলেন একজন শেখের, যিনি কোরআনের কিছু সুনির্দিষ্ট অংশ পড়তে উপদেশ দিতেন। তিনি বললেন, এ সময়ই আমার মধ্যে পরিবর্তন আসে। এ সময় অন্য এক ব্যক্তি সালাফিস্টদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে তথ্য নিয়ে আমাকে কয়েকটি ডিস্ক প্রদান করেন। অধিকাংশ ডিস্কে ইবনে বাজ এবং ইবনে ওতাইমেনর মতো শেখদের বক্তব্য ছিল। পরে ওই ভদ্রলোক আমাকে কিছু ভিডিওচিত্র দেন, যাতে ইসলামের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে অস্বীকার করা হয়েছে এবং সুফিদের ও শিয়াদের আক্রমণ করা হয়েছে। ওই শেখ এক বছরের জন্য জেলখানায় ছিলেন। পরে দামেস্কে মোহাম্মদ আমিন আলীর রুমমেট ছিলেন।
মোহাম্মদ জানালেন, সিরিয়ায় যখন বিদ্রোহ দেখা দেয়, শেখ ও অন্য দুজন তখন তাঁকে উপদেশ দেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে। মোহাম্মদ বললেন, 'যখন জুমার নামাজ শেষ হতো, তখন আমাদের মধ্যে কেউ একজন জনগণের মধ্যে উঠে দাঁড়াতেন এবং সরকারের অন্যায় ও মন্দ পরিস্থিতি নিয়ে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতেন। তখন অন্য চারজন বিভিন্ন কোণ থেকে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করতেন।'
আমিন আলীর মতে, এ সময় তাঁর একজন সালাফিস্টের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, যাঁর নাম আল হাজের। তিনি তখন আমিন আলীকে মেডিক্যাল ও অন্যান্য সহায়তা দিতে অনুরোধ জানান। এ সময় তাঁর ঘরে অনেক অপরিচিত লোক আসা-যাওয়া করতে শুরু করে।
পরে একজন সালাফিস্ট তাঁর মাকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য আমিন আলীকে অনুরোধ করেন। কারণ তিনি একজন ডাক্তার। সেই হাসপাতালে সিরিয়ার মুখাবারাত সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরা অপেক্ষমাণ ছিলেন। আমিন আলী বললেন, 'আমি পরিষ্কার করেই তাঁদের বললাম, রক্তক্ষয়ী ওই গ্রুপের সঙ্গে থাকার চেয়ে বরং গ্রেপ্তার হওয়াটাই আমার জন্য শ্রেয়। আমি জানি না কী করে এসব লোকের সঙ্গে আমি নিজেকে জড়িত করেছি। আমি নিজেকে একটি ডাস্টবিনে ঠেলে দিয়েছিলাম।'
মোহাম্মদ আমিন আলী দুই মাস আগে তাঁর স্কুলশিক্ষক বাবা, মা ও বোনকে দেখেছেন। আমরা তাঁর কাছে জানতে চাইলাম তাঁকে কী নির্যাতন করা হয়েছে? তিনি বললেন, 'শুধু একদিন। সেটাও বিশেষ কোনো নির্যাতন ছিল না।' আমরা জানতে চাইলাম, তাঁর হাতে দুটো গভীর কালো দাগ কিসের? তিনি বললেন, 'টয়লেটে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।'
জামেল আমের আল খদুদ আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রী ও শিশুরা মারসেইলিতে বসবাস করে। তিনি নিজে ফরাসি সেনাবাহিনীর প্রথম ট্রান্সপোর্ট রেজিমেন্টে চাকরি করতেন। ৪৮ বছর বয়সের এই ভদ্রলোক আরো বেশি বশীভূত হয়ে আছেন। তাঁর জিহাদে যোগ দেওয়ার কাহিনীটি আরো করুণ। তিনি নাকি আল জাজিরায় প্রচারিত সিরিয়ায় মুসলমানদের করুণ অবস্থা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তিনি ফ্রান্সে অভিবাসী। ভালো ফরাসি ভাষা জানা সত্ত্বেও তিনি সেখানে বেকার ছিলেন এবং টুকটাক কাজ পেয়েছেন। অনেক দিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে তিনি তুরস্কে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেখানে সিরিয়ার আশ্রিতদের সহায়তা করার ইচ্ছা রাখেন।
তাঁর মতে, তিনি ছিলেন একজন নরমপন্থী সালাফিস্ট। কিন্তু তুরস্কের রিফিউজি ক্যাম্পে তিনি একজন লিবিয়ান শেখ, একজন ইয়েমেনের ইমাম ও তিউনিসিয়ার বহু লোকের সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁরাই তাঁকে জিহাদি শিক্ষা দান করেন। তিনি বলেন, তিনি টেলিভিশনে যা দেখে থাকেন, তা সিরিয়ার অভ্যন্তরে দেখেননি। সন্দেহভাজন লোকেরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং হেলিকপ্টারে করে দামেস্কে নিয়ে আসা হয়। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তিনি ফিলিস্তিনে না গিয়ে সিরিয়ায় জিহাদ করতে এলেন? তিনি উত্তরে বললেন, 'একজন ফিলিস্তিনি বন্ধু আমাকে বলেছেন, তাঁদের লোকবলের চেয়ে বরং অর্র্থের প্রয়োজন বেশি। তা ছাড়া ফিলিস্তিনের সীমান্ত অতিক্রম করা অনেক কঠিন।' তাঁর কাছে জানতে চাইলাম তাঁকে কোনো অত্যাচার করা হয়েছে কি না। তিনি বললেন, 'আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি ভালো আছি।'
এভাবে সাড়ে চার ঘণ্টা সাক্ষাৎকার গ্রহণের পর আমরা সিরিয়ার কারা কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানালাম তাঁদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়ার। কারাগারপ্রধানের ক্লান্ত হাসিতে মনে হলো, বাইরেই তাঁর জন্য যথাযথ ক্ষমা অপেক্ষা করছে। আমরা মোহাম্মদ আল আবদুল্লাহকে একটি কলম ও কাগজ দেওয়ার জন্য আবেদন করলাম। বললাম বন্দিদের জন্য আন্তর্জাতিক আইন নিশ্চিত করার কথা। বন্দিরা কারাপ্রধানের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন বন্ধুত্বের ভাব নিয়ে। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম, তাদের মধ্যে প্রকৃত অর্থে আন্তরিকতার কোনো ছোঁয়া নেই। প্রত্যেক বন্দি ফিরে গেলেন, যেভাবে গভর্নরের কক্ষে এসেছিলেন, ঠিক সেভাবে। মাথা নিচু করে পায়ের নিচে মেঝের দিকে তাকিয়ে।
লেখক : দি ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি
ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.