পাকিস্তান- যত গর্জে তত কি বর্ষে? by নাজাম শেঠি

‘যত গর্জে তত বর্ষে না’—ইমরান খানের ‘সুনামি’ কি সেই রকম? তিনি দাবি করছেন, তাঁর দলের ‘কার্ডধারী’ সদস্যসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বলছেন, শিগগিরই তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হবে স্বচ্ছ ও খাঁটি অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের মাধ্যমে।


পরনির্ভরশীল ও প্রায়-ব্যর্থ রাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটা সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তর করার পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর সেই পরিকল্পনার অর্ধেকও যদি বাস্তবায়িত হয়, সেটা হবে অসাধারণ অর্জন।
এই সংস্কার কর্মসূচি আসাদ উমর ও জেহাঙ্গির তারিনের কাজ। উমর সাহেব একজন করিতকর্মা করপোরেট ব্যবস্থাপক। সচল, প্রবৃদ্ধিমুখী একটি কোম্পানি একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক যেভাবে চালান, তিনি পাকিস্তান পরিচালনা করতে চান সেইভাবে। কিন্তু তাঁর সমস্যা হলো, ক্ষমতার নানা ভরকেন্দ্রের চাপে কলকবজা ঢিলে হয়ে পড়ছে যে দেশটির, সেই পাকিস্তানকে একটিমাত্র উচ্চতর স্থান থেকে পরিচালনা করা যে সম্ভব নয়, এটা বোঝার মতো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। এ ধরনের জটিল ফ্যাক্টরগুলোর কারণেই অন্তত তিনজন সামরিক স্বৈরশাসক প্রধান নির্বাহীর স্টাইলে পাকিস্তানের জন্য একটি টেকসই স্বনির্ভর গতিপথ নির্ধারণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। জেহাঙ্গির তারিন একজন বড় কৃষি-বণিক, তিনি মুসলিম লীগে থাকা অবস্থায় যখন নিজে একটা ‘ক্লিন পার্টি’ গঠনের কথা ভাবছিলেন, তখন ইমরান খান নিজের ক্যারিশমায় তাঁকে দলে ভেড়ান। তারিন একজন পাকাপোক্ত প্রতিষ্ঠানপন্থী মানুষ, পিটিআই দলের ‘বিপ্লবী’ স্বভাবের সান্নিধ্যে তিনি প্রায়শই অস্বস্তিবোধ করেন।
পাকিস্তানকে বদলে দেওয়ার যে রূপকল্প তাঁরা দাঁড় করিয়েছেন, তাতে এ দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রকৃতি সম্পর্কে অনুমানগুলো অবাস্তব। এর মূল ভাবনা রাজস্ব দ্বিগুণ করা ও খরচ কমানো, যাতে করে সামাজিক কল্যাণ খাতের জন্য অর্থসংস্থান করা যায় এবং বিদেশি অর্থের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এটা কোনো নতুন ভাবনা নয়। এটা বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়। রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কালোটাকা সাদা করা, সর্বজনীন করারোপ, কর-শুল্ক আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা, কর-প্রণোদনা ও নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ। এগুলোও নতুন কিছু নয়। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিলে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে একবার মাত্র কিছু অর্থ যোগ হয়। কঠোর পদক্ষেপগুলো সংবাদমাধ্যমে বেশ হইচই সৃষ্টি করে, কিন্তু তাতে পুঁজি বাইরে চলে যাওয়ার ঝোঁক বাড়ে। করপ্রস্তাবগুলো কাগজে-কলমে বেশ ভালোই দেখায়, কিন্তু সেগুলোকে আইনগত ভিত্তি প্রদান করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা মার খেয়ে যায় সংসদের ভেতরের ও বাইরের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর কাছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, জনগণকে খুশি করতে গত বছর বর্তমান সরকারের মূল্য সংযোজন কর আরোপের বিরুদ্ধে প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন ইমরান খান। তাঁর দল সেই সব রাজনীতিককেই নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখছে, যাঁরা প্রতিটি সরকারের আমলে সুশাসনের সবচেয়ে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছেন। কর সংগ্রহের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড (সিবিআর) দুর্নীতি, অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক বৈকল্যে এতই বেসামাল যে প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর আমলে তারা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। রাজস্ব বোর্ডে অনেক শক্তিমান ও উত্তম চেয়ারম্যান এসেছেন ও গেছেন, কিন্তু কিছুই তাঁরা করতে পারেননি। বিচার-প্রক্রিয়ায় আপিলের ক্ষেত্রে অসহযোগিতার ঝোঁক বেশি, প্রসিকিউশন প্রশিক্ষণহীন, প্রশাসনিকভাবে দুর্বল, উৎসাহ-উদ্দীপনারও ভীষণ অভাব।
ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করাও অত্যন্ত কঠিন। সরকারি খাতের লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ভর্তুকিই বা কীভাবে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস করা যাবে? লাখ লাখ লোককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হলে রাস্তায় রাস্তায় উঠবে রাজনৈতিক ঝড়, আদালতে জমবে মামলার পাহাড়। ‘পাকিস্তানের আদর্শ ও সার্বভৌমত্বের’ বিরুদ্ধে কল্পিত এবং বাস্তব বিরাট বিরাট হুমকির মুখে কীভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাবে প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়?
ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে এ রকম অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবিক দুর্বলতা রয়েছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও ক্ষমতার ‘প্রকৃত’ ইস্যুগুলোকে ভীষণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে অথবা ভুলভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেমন, ইমরান খান বলেছেন, দেশে জাতীয় শিক্ষানীতি হবে একটি। কিন্তু শিক্ষানীতির যে আদর্শগত বিষয়গুলোর কারণে গত চার দশকে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রতা, সামাজিক অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্বেষ বেড়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে, জাতিরাষ্ট্রবিরোধী সেই উপাদানগুলো নিয়ে ইমরান খান আলোচনার সূত্রপাতই করেননি।
সংস্কার কর্মসূচিতে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা আরোপ করা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক চীনের ওপর—যে চীন পাকিস্তানকে না দেয় ঋণ, না করে দান। পাকিস্তানে চীন কোনো বিনিয়োগও করে না। আর পুঁজিবাদী বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উৎস পশ্চিমা বিশ্বকে ছোট করে দেখানো হয়েছে, পরিত্যাগ করতে চাওয়া হয়েছে। সামরিক বাহিনীর যেসব ভূমিকা ও নীতি পাকিস্তানের জনগণের শান্তি-সুরক্ষা ও কল্যাণের সঙ্গে গুরুতরভাবে সম্পর্কিত, ইমরানের দল সেসব বিষয়ে আলোচনা সচেতনভাবে এড়িয়ে যায়। আঞ্চলিক নীতি সম্পর্কে তাদের বক্তব্যগুলো বিরোধপূর্ণ, অসংগতিতে ভরা।
ইমরান খান ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন, কিন্তু তিনি জানেন না, পাকিস্তানে ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহূত হয়ে আসছে; জানেন না, কেন এই প্রক্রিয়ার আমূল পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
নাজাম শেঠি: পাকিস্তানের সাংবাদিক। ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য ফ্রাইডে টাইমসের সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.