কত টাকা চুরি হলে বড় দুর্নীতি হয়

গ্রাহকদের কাছ থেকে সোনালী ব্যাংক গত বছর পাঁচ হাজার ৩১ কোটি টাকার আমানত গ্রহণ করেছিল। আর ঋণ দিয়েছিল ছয় হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। আর ব্যাংকটির একটি শাখা থেকেই কয়েকটি কম্পানি ঋণপত্র জালিয়াতি করে সরিয়ে নিয়েছে তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।


এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ নামের অখ্যাত একটি কম্পানি একাই নিয়ে গেছে দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ কেলেঙ্কারি নিয়ে সারা দেশে যখন তোলপাড়, তখন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মঙ্গলবার বললেন, 'চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কোনো ঘটনা নয়। ব্যাংকিং খাতে আমরা ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিই। অথচ মাত্র চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে যা প্রচারিত হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাংকিং খাতেই ধস নেমেছে।'
গতকাল বুধবারও জোর দিয়ে একই কথা বলেছেন তিনি। নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে গতকাল সচিবালয়ে নিজের দপ্তরের সামনে সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমি এখনো বলছি, চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না। আমি (ব্যাংকগুলো) গত বছর ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছি। সেখানে চার হাজার কোটি টাকা কত? মাত্র টেন পারসেন্ট (১০ শতাংশ)। তবে এ ধরনের ঘটনা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই খারাপ।'
অর্থমন্ত্রীর এ মন্তব্যের কারণে স্বভাবতই একটা প্রশ্ন ওঠে যে কত টাকা চুরি হলে অর্থমন্ত্রীর কাছে বড় দুর্নীতির ঘটনা বলে মনে হবে? এ ছাড়া তাঁর এ ধরনের মন্তব্য দেশের ব্যাংক খাত সম্পর্কে দেশের ভেতর ও বাইরে ভুল সংকেত পাঠাবে বলে মনে করেন এ খাতের বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলেন, রাষ্ট্র খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটির সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় নজিরবিহীন এ ব্যর্থতার দায় নিয়ে অর্থমন্ত্রীর যেখানে লোপাট হওয়া অর্থ আদায় ও দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি বিধানে তৎপর হওয়ার কথা, সেখানে তিনি জালিয়াতির ঘটনাটিকেই হালকাভাবে নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।
সাবেক ব্যাংকার ও ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের পরিচালক মামুন রশিদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, জালিয়াতির এ ঘটনাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্য পুরো ব্যাংক খাত সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। এতে খারাপ ঋণগ্রহীতারা উৎসাহিত হবে। পর পর দুই বছর মুডিস ও এসঅ্যান্ডপির ইতিবাচক ঋণমানের (ক্রেডিট রেটিং) ফলে বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে বেসরকারি খাতের লেনদেন এখন অনেক সহজ হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের এ ঘটনা ভবিষ্যৎ রেটিংকে প্রভাবিত করতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে মামুন রশিদের। তিনি বলেন, কেলেঙ্কারি কেবল সোনালী ব্যাংকের মধ্যেই সীমিত থাকেনি। রাষ্ট্র খাতেরই আরো দুটি এবং বেসরকারি খাতেরও অন্তত দুটি ব্যাংক এতে জড়িয়ে পড়েছে। সোনালী ব্যাংক সরকারি মালিকানার। এর কর্মকর্তা ও বোর্ড সরকার নিয়োগ দেয়। সরকারের নিয়ন্ত্রণ পাকাপাকি করার জন্যই অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নামে আলাদা একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। তাই সোনালী ব্যাংকের এ কেলেঙ্কারির দায় এড়ানোর সুযোগ নেই অর্থমন্ত্রীর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অবশ্য মনে করেন, অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে খানিকটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। তাঁর মতে, অর্থমন্ত্রী হয়তো বলতে চেয়েছেন, এ ঘটনায় সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে ধস নামবে না। তবে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর ধারণা সত্যি হবে যদি দ্রুতগতিতে টাকা উদ্ধার হয় এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, কত টাকার কেলেঙ্কারি হলো-না হলো, এর চেয়ে বড় কথা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও ব্যর্থতা, যা এ ঘটনায় প্রকাশ পেল। এ ঘটনা তো এক দিনে ঘটেনি, দুই-আড়াই বছর ধরে চলেছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনার কোথায় গলদ আছে, পদ্ধতিগত ত্রুটি কোথায় কোথায় আছে, সেগুলো দেখতে হবে। টাকা উদ্ধারের জন্য অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে, ফৌজদারি অপরাধের জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ও অর্থপাচার আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি অবশ্যই অনেক বড় ঘটনা। এটি স্বাভাবিক কোনো ঋণ দেওয়ার ঘটনা নয়। এটি রীতিমতো জালিয়াতি।
এর আগে তদারকির ব্যর্থতার জন্য সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। কিন্তু অর্থমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, সরকারি ব্যাংকের পর্ষদের ব্যাপারে এ ধরনের অনুরোধ করার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। কিন্তু ব্যাংক কম্পানি আইনেই উল্লেখ রয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি ব্যাংক সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের পরামর্শ দিতে পারে।
সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ যে উপেক্ষিত হয়েছে তা গতকালের নির্দেশনায় অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। গতকালই অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মেয়াদকাল দুই বছর করে বাড়ানো হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকবেন সোনালী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যানও। পর্ষদে নতুন করে কারা ঢুকবেন বা কারা বাদ পড়বেন, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো কাজ করছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ব্যাংক খাতের অভিজ্ঞতা নেই, এমন ব্যক্তিদেরও রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। ৮ সেপ্টেম্বর সোনালী ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ বেশির ভাগ পরিচালকের তিন বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এবার পরিষদ পুনর্গঠন করলে রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়ে পেশাগত দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে- বিশেষজ্ঞরা এমনটিই আশা করেছিলেন।
বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, 'আমরা এ ব্যাপারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মতামত দিয়েছি। আমরা সরকারের কেউ নই। নতুন পরিষদে আমাদের পরামর্শের প্রতিফলন দেখলে আমরা আশ্বস্ত হব। আর না হলে দুঃখ পাব।'
কালের কণ্ঠকে ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরো বলেন, রাজনৈতিক পরিচিতি পর্ষদের সদস্য হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি হওয়া অবশ্যই উচিত নয়। দেখা উচিত যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তিনি সৎ কি না, নিরপেক্ষ কি না, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অন্তত চলনসই জ্ঞান তাঁর আছে কি না।
একই রকম মন্তব্য মামুন রশিদের। তিনি বলেন, ব্যাংকের পর্ষদের যিনি সদস্য হবেন, তাঁকে অবশ্যই ব্যাংকিং বুঝতে হবে, আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনার ধারণা থাকতে হবে, ব্যালান্স শিট বুঝতে হবে। এমন যোগ্য ব্যক্তি যদি আওয়ামী লীগেরও কেউ হন, তাঁকে ব্যাংকের পরিচালক করতে দোষের কিছু নেই। সরকার চাইলে সে রকম যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বোর্ড পুনর্গঠন করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স বিভাগেই এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা আওয়ামী লীগ-সমর্থিত 'নীল' দলের সদস্য, সেখান থেকেও সরকার বেছে নিতে পারে। পাকিস্তানের তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, জেপি মরগ্যান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে কাজ করেছেন এমন যোগ্য পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সেসব ব্যাংকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো স্বাধীনভাবে চলছে। সরকারের সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ব্যক্তিরও হস্তক্ষেপ চলে না সেখানে।

No comments

Powered by Blogger.