ড্যাবের তিন চিকিৎসক হত্যার 'ষড়যন্ত্র' ফাঁস-র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ৬

বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) নেতৃস্থানীয় তিন চিকিৎসককে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছিল বলে দাবি করেছে র‌্যাব। এ অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো ড্যাব নেতা ডা. কামরুল হাসান এবং পেশাদার সন্ত্রাসী মিঠু ওরফে প্রশান্ত, জয়নাল আবেদীন, তওফিকুল ইসলাম তুষার, মহরম আলী ও মো. মোস্তফা।


তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল, গুলি ও ছোরা উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে র‌্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের হাজির করা হয়। নেতৃত্বের বিরোধে ডা. দোলনের নির্দেশে গ্রেপ্তারকৃতরা ড্যাব মহাসচিব ডা. জাহিদ গ্রুপের তিন চিকিৎসককে হত্যার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা চালায় বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান।
র‌্যাবের মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল জানান, ড্যাবের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তিনজন চিকিৎসককে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ড্যাব মহাসচিব ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্য গ্রুপের নেতা বিএনপির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মাজাহারুল ইসলাম দোলন। গত রমজান মাসে একটি অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রে তাঁদের বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। এরই সূত্রে ডা. জাহিদের অনুসারী মোহাম্মদপুর এলাকার ডা. মোফাখখারুল ইসলাম রানা, ভাষানটেক এলাকার ডা. বাহার ও শেওড়াপাড়া এলাকার ডা. উজ্জ্বলকে হত্যার পরিকল্পনা হয়। তিন চিকিৎসক হত্যার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় দন্ত চিকিৎসক ডা. কামরুলকে। পেশাদার অপরাধীদের দিয়ে এসব হত্যা সংঘটিত করার চেষ্টা হলেও র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি জেনে যায়। মূলত র‌্যাবের গোয়েন্দা নজরদারির কারণেই এই তিন ডাক্তার খুনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতরা ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ডা. দোলনের নাম জানিয়েছে। তাঁকে আটকের চেষ্টা চলছে।
র‌্যাব সূত্র জানায়, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ড্যাব মহাসচিব ডা. এ জেড এম জাহিদ ও বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. দোলনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। সম্প্রতি ইফতার অনুষ্ঠানে হাতাহাতির ঘটনায় ডা. দোলন প্রতিপক্ষ গ্রুপের তিন চিকিৎসকের ওপর ক্ষিপ্ত হন। ডা. রানা, ডা. বাহার ও ডা. উজ্জ্বলকে হত্যার জন্য ডেন্টাল কলেজের সাবেক ছাত্রদল সভাপতি ডা. কামরুলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কামরুল প্রথমে মিরপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী গাজী সুমনের সহযোগী মিঠুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর মিঠু তার অন্য সহযোগীদের নিয়ে চূড়ান্ত বৈঠক করে। সেখানে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১২ আগস্ট ডা. রানাকে হত্যার জন্য তাঁর চেম্বার মিরপুরের ডিজি ল্যাবে যায় অস্ত্রধারীরা। কিন্তু ডা. রানা সেদিন চেম্বারে ছিলেন না। তাঁকে না পেয়ে সন্ত্রাসীরা ফিরে যায়। র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট নানা সূত্রে এ হত্যা পরিকল্পনার কথা জেনে যায়। তারা সন্দেহভাজনদের অনুসরণ করতে থাকে। পরদিন ডা. রানা এক সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের তথ্য প্রকাশ করেন। এ নিয়ে বিরোধ আরো তীব্র হয়।
অন্যদিকে র‌্যাবের নজরদারি শুরু হলে সন্ত্রাসী মিঠু গা-ঢাকা দেয়। মিঠুর সঙ্গে ডা. কামরুলের কিছুদিন যোগাযোগ বন্ধ থাকে। ডা. কামরুল মিঠুকে না পেয়ে প্রতিপক্ষ ডা. উজ্জ্বল ও ডা. বাহারকে হত্যার জন্য মামুন নামের অন্য এক সন্ত্রাসীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে গত ১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসীরা ডা. উজ্জ্বলকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর পিছু নিলে র‌্যাব-৪-এর একটি দল দ্রুত অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের আটকে র‌্যাবের টিম অভিযান চালাচ্ছে।
র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর ডা. কামরুল তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে সাংবাদিকদের জানান, গত রমজানে ইফতার পার্টিতে ড্যাব মহাসচিব ডা. জাহিদের সমর্থকদের সঙ্গে তাঁদের কথাকাটাকাটি হয়। সেখানে চরম অপমানিত হয়ে প্রতিশোধ নিতেই তিন চিকিৎসককে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এ জন্য তিনি সন্ত্রাসীদের ভাড়া করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ডা. মোফাখখারুল ইসলাম রানা সাংবাদিকদের বলেন, দলীয় কোন্দলের কারণে তাঁদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এটা দুঃখজনক। সামান্য কারণে তাঁদের তিনজনকে হত্যার পরিকল্পনায় তিনি ডা. দোলনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রহস্য উন্মোচন করার জন্য তিনি র‌্যাবকে ধন্যবাদ জানান।
এ ব্যাপারে ড্যাব মহাসচিব ডা. জাহিদ সাংবাদিকদের জানান, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। তবে শুনেছেন ড্যাব সদস্য রানার ওপর সন্ত্রাসী হামলা চলানো হয়। কারা এ হামলার সঙ্গে জড়িত তা তাঁর জানা নেই। ড্যাবে কোনো অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। আর ডা. দোলন ড্যাবের নেতা নন। তিনি একসময় ড্যাবের সদস্য ছিলেন। পরে তা নবায়ন করেননি। এখন তাঁর সদস্যপদ নেই।
র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, গত ৯ আগস্ট তাঁরা গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে জানতে পারেন, মিরপুর এলাকার সন্ত্রাসী মিঠু তিন ব্যক্তিকে হত্যার জন্য ডা. কামরুলের সঙ্গে চুক্তি করেছে। প্রকৃত বিষয় জানতে ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য ডা. কামরুল ও সন্ত্রাসী মিঠুর ওপর গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত থাকে। গত ১১ ও ১২ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে ডা. রানাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাঁচজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী যায়। কিন্তু র‌্যাবের টহলদল দেখে সন্ত্রাসীরা সরে যায়। পরে ডা. রানা তাঁর জীবননাশের চেষ্টা করা হয়েছে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন। মিঠু তার সহযোগীদের নিয়ে গা-ঢাকা দেয়। র‌্যাব সোর্সের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়, রবিবার ডা. কামরুল ও সন্ত্রাসী মিঠু চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বৈঠক করবে। সে মোতাবেক অভিযান চালিয়ে রাতে মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনের ৩ নম্বর রোডের ফায়ার সার্ভিস-সংলগ্ন এলাকায় একটি নির্মাণাধীন বাড়ির সামনে থেকে ডা. কামরুলসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করে তিনটি গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি ধারালো ছোরা উদ্ধার করা হয়। টেলিফোন যোগাযোগ ও আটক ব্যক্তিদের তথ্যে জানা গেছে, ড্যাবের নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের জের ধরে ডা. দোলন তিন চিকিৎসককে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডা. কামরুল ও ডা. ইরফানকে।

No comments

Powered by Blogger.