মোজাফফর আলী- অন্তর যাত্রার মধ্যেই বিশ্বরূপের দেখা পাই

ভারতীয় কাহিনিচিত্রের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসবে প্রদর্শিত হলো মোজাফফর আলী পরিচালিত ওমরাও জান ছবিটি। নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে প্রথমবারের মতো ঢাকা এসেছেন ‘ভারতীয় নতুন সিনেমা’র খ্যাতিমান এই নির্মাতা।


মোজাফফর আলী চলচ্চিত্রকার, ফ্যাশন ডিজাইনার, চিত্রশিল্পী। কবিতা আর সংগীত তাঁর শিল্পযাত্রায় যমজ বোনের মতো। লক্ষেৗর বনেদি পরিবারে জন্ম। বসবাসও করেন ঐতিহ্যবাহী এই শহরেই। লক্ষেৗর সংস্কৃতি তাঁর সবকিছুর সঙ্গে মিশে আছে। ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত দীর্ঘদেহী সুদর্শন ৬৭ বছরের এই শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন

অঞ্জন: ভারতীয় কাহিনিচিত্রের শতবর্ষপূর্তিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মোজাফফর: পেছন ফিরে দেখার জন্য এটা একটা ভালো উপলক্ষ। দুইভাবে আমি বিষয়টাকে দেখতে চাই; প্রথমত, এটা একটা সম্মিলিত যাত্রা। নানাভাবে আমি সেটার অংশীদার, এমনকি দর্শক হিসেবেও। এই দীর্ঘ সময়ে ভারতবর্ষে অনেক ভালো ছবি তৈরি হয়েছে। বিশ্বে আমাদের চলচ্চিত্র একটা আলাদা জায়গা তৈরি করতে পেরেছে। আবার অনেকে বলেন, আমাদের সিনেমা এখন রসাতলে গেছে। অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছে, অর্থ ছাড়া এর আর অন্য কোনো মোক্ষ নেই। শিল্প তো অনেক পরের ব্যাপার। অন্যদিকে চলচ্চিত্রকার হিসেবে এটা আমার নিজস্ব অভিযাত্রাও বটে। সেটা একেবারে অন্য রকম। সিনেমা আমার কাছে একটা পবিত্র শিল্প। আমার অন্তরের অনুভূতি আমি ছবির মধ্যে দেখতে চাই। এ কারণে আমাকে সব সময় স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়াতে হয়েছে। শিল্পী হিসেবে সেটা সব সময় খুব সহজ ছিল না।
অঞ্জন: তা হলে আপনি সিনেমাকে কীভাবে দেখতে চান?
মোজাফফর: চলচ্চিত্র নির্মাণ আমার কাছে সব সময় একটা পরিকল্পিত সৃজনশীল কাজ। কলকাতায় আমি আমার প্রথম শিল্পযাত্রা শুরু করি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেছি। তাঁর কাছ থেকে আমি শিখেছি, কী করে একটা ছবির পরিকল্পনা করতে হয়; বিশেষ করে চিত্রনাট্য তৈরির সময়। আমি ‘সিনেমা ভেরিতে’ ধরনের তাৎক্ষণিক অপরিকল্পিত কিছু করতে চাই না। আমি ছবির প্রতিটি ফ্রেম এঁকে নিই, রং-আলো-পোশাক, প্রতিটি আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি আমি অনেক যত্ন নিয়ে করি। আমি একটা ছবির সংগীত পরিচালনা করতে এক বছরেরও বেশি সময় ব্যয় করি। আজকাল সিনেমা অনেক সস্তা ধরনের হয়ে গেছে। তারকা, নাচ, গান আর অর্থের চাকচিক্য। আমি সব সময় এগুলোর বাইরে থাকতে চাই।
অঞ্জন: কিন্তু আপনার ছবিগুলোর মধ্যেও তো তারকা, নাচ, গান, সরল কাহিনি, বাণিজ্যিক ছবির সবকিছুই তো আছে, তাই না?
মোজাফফর: না না, তা নয়। আমি এগুলোকে একেবারেই সস্তা বিনোদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করিনি। এই উপাদানগুলোকে আমি গভীর ও সংগঠিতভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছি। কবিতা আর সংগীত আমার জীবনে আনন্দধারার মতো। আমি এর মধ্যে বসবাস করি। এটা আমার অন্তর থেকে উৎসারিত, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কিছু নয়।
অঞ্জন: চলচ্চিত্রের বাইরেও তো আপনি ফ্যাশন ডিজাইনার, চিত্রশিল্পী, সংগীত পরিচালক...
মোজাফফর: আমি সব সময় কিছু না কিছু করতে থাকি। প্রায় সব মাধ্যমে আমি ছবি আঁকি—তেলরং, জলরং এমনকি এচিং পর্যন্ত। পোশাক ডিজাইন করি, গান, কবিতা এগুলো তো আছেই। আমি শিল্পের মাধ্যমে মানুষের অনুভূতিগুলোকে বুঝতে চেষ্টা করি এবং আমার ভাবনা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। যেকোনো মাধ্যমে শিল্পযাত্রাই আমার কাছে অন্তরযাত্রা, যার মধ্যে আমি বিশ্বরূপের সন্ধান করতে থাকি।
অঞ্জন: ঐতিহাসিক কাহিনির প্রতি কি আপনার কোনো আলাদা দুর্বলতা আছে?
মোজাফফর: হ্যাঁ, ঐতিহাসিক বিষয়গুলো আমাকে অনেক বেশি আগ্রহী করে। শিল্পী হিসেবে আমি সব সময় আমাদের শিকড়ের সন্ধান করতে থাকি। আমার মনে হয়, উপনিবেশ আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। তারা আমাদের ঐতিহ্য থেকে, আমাদের শিকড় থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে। দেখুন, আমরা এখন ইংরেজিতে কথা বলছি। আমি আমার শিল্পের মধ্যে সেই বিচ্ছিন্ন সম্পর্কের সন্ধান করি। আমার দর্শকদেরও আমি সেই অনুসন্ধানে শামিল করতে চাই। সে কারণেই আমি ছবির মধ্যে কাহিনির অবতারণা করেছি। যাতে দর্শক মনোযোগ দিয়ে গল্পটা দেখে, তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করে।
অঞ্জন: আপনি তো সুফি কবিতা, গান নিয়ে বেশ আগ্রহী?
মোজাফফর: সুফি শিল্পীদের মতো আমিও বিশ্বাস করি, হূদয় থেকে উৎসারিত সত্যই আপনাকে সঠিক লক্ষ্যে নিয়ে যাবে। লক্ষেৗতে আমরা একটা সুফি গানের উৎসব করি। আমি নিজে অনেক ছোট ছবি নির্মাণ করেছি সুফি বিষয় নিয়ে। এটা আমার জন্য একটা আত্মানুসন্ধানের পথ। মওলানা জালালউদ্দীন রুমী আমার প্রিয় কবি ও দার্শনিক। একজন মহান শিল্পী।
অঞ্জন: আপনি তো রুমীকে নিয়ে একটা ছবি বানানোর পরিকল্পনা করেছেন?
মোজাফফর: অনেক দিন ধরেই আমি রুমীর ওপর একটা ছবি বানাতে চাই। চিত্রনাট্য নিয়ে আমি অনেক কাজ করেছি। এমনকি প্রতিটা ফ্রেমের ছবি পর্যন্ত এঁকে ফেলেছি। সমস্যা হচ্ছে, রুমী চরিত্রে অভিনয় করার মতো আমি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। আর যেভাবে ছবিটির পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে অনেক টাকা-পয়সার দরকার, সেটা জোগাড় করা খানিকটা অসম্ভবই মনে হচ্ছে। জালালউদ্দীন রুমীকে নিয়ে এলেবেলে কিছু করা ঠিক হবে না।
অঞ্জন: আপনি দীর্ঘদিন কোনো ছবি তৈরি করছেন না কেন?
মোজাফফর: আগে যেমন বললাম, আমি হূদয়-তাড়িত লোক। যা হচ্ছে না, তা নিয়ে আফসোস না করে আমি কোনো একটা কিছুর মধ্যে থাকতে চাই। আমি নিজেকে একজন শিল্পী মনে করি; সৃজনশীলতা আর ভালোবাসার মধ্যে আমি বেঁচে আছি। আর বাদবাকি যা হওয়ার হবে, না হলে না হবে। কোনো অনুশোচনা নেই।
অঞ্জন: ঢাকায় প্রথম এলেন। কেমন লাগছে?
মোজাফফর: সবে তো এলাম। ঢাকা তো অনেক পুরোনো শহর। আর বাঙালিদের সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। খানিকটা কলকাতার মতো। সবাই খুব শিল্পরসিক। শিল্পীদের খুব ভালোবাসে। কোমল হূদয় না থাকলে শিল্প ভালোবাসা যায় না। এটা একটা খুব বড় ব্যাপার। কোনো কাজ নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসতে পারলে ভালো লাগবে। তখন হয়তো ঢাকা থেকে দূরে কোথাও গিয়ে বাউল গান শুনব।

No comments

Powered by Blogger.