৮৪ লাখই কি মালিক?-গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন ॥ মিশন খতিয়ে দেখবে by মিজান চৌধুরী

মিজান চৌধুরী ॥ গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লাখ সদস্যকে মালিক হিসেবে মুনাফার লভ্যাংশ আদৌ দেয়া হতো কি না তা খতিয়ে দেখছে তদন্ত কমিশন। বিভিন্ন সময়ে দেয়া রেয়াতের টাকা কোন্ খাতে ব্যয় করা হয়েছে তাও দেখা হচ্ছে। কমিশন এসব বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে।


যদিও গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে এই ব্যাংকের মালিক এর সদস্যরাই। সদস্যদের মালিক বলা হলেও ব্যাংকের মালিকানা হিসেবে ওদের শেয়ারের কাগজও দেয়া হয়নি। এমন তথ্য দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। তাঁর মতে, এক শ’ টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হওয়ার বিষয়টি কাগুজে। আদপে মালিক হিসেবে একজন সদস্যের গ্রামীণ ব্যাংকে কোনই কর্তৃত্ব নেই।
এদিকে বৃহস্পতিবার গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের বিধান ‘সংশোধিত গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ’ জারির প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয়। ফলে খুব শীঘ্রই এই ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। মূলত এই সংশোধনীর মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক শুরুর অবস্থায় নেয়া হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠাকালে পরিশোধিত মূলধনে সরকারের অংশ বেশি ছিল। কিন্তু ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালনা পর্ষদে সরকারের কোন প্রতিনিধি দেয়া হয়নি। গ্রামীণ ব্যাংকের শুরুতে পরিশোধিত মূলধন ছিল ৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং ঋণগ্রহীতাদের ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ফলে ব্যাংক পরিচালনায় সরকারের অনুপাত ৬০ ভাগ এবং ভূমিহীন ঋণগ্রহীতাদের অনুপাত ৪০ শতাংশ ছিল।
গ্রামীণ ব্যাংকের ৫ হাজার টাকার ঋণ কাউকে দেয়া হলে এক শ’ টাকা কেটে রাখা হয় মালিকানার সদস্য হিসেবে। এভাবে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে টাকা কেটে রাখার ফলে এক সময় ঋণগ্রহীতাদের দেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং সরকারের ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা থেকে যায়। পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ সরকারের তুলনায় ঋণগ্রহীতাদের বেশি হওয়ার ফলে এবার গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা বিন্যাসের প্রস্তাব দেয়া হয় তৎকালীন ও বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। তিনি সেটি করেননি।
অবশ্যই ১৯৮৬ সালের ৮ জুলাই গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা বিন্যাস পরিবর্তন অধ্যাদেশ সংশোধন করেন পরবর্তী অর্থমন্ত্রী সাঈদুজ্জামান। এই মালিকানা বিন্যাস পরির্বতনের ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের ৭৫ ভাগ মালিকানা চলে যায় ঋণগ্রহীতাদের কাছে এবং ৬০ শতাংশ থেকে সরকারের মালিকানা কমে দাঁড়ায় ২৫ শতাংশে। সে মোতাবেক গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড গঠনেও পরিবর্তন আনা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই আরেকটি সংশোধনী আনা হয়। সেই সংশোধনীতে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে পরিচালনা পর্ষদ, সরকার নয়Ñ এমন বিধান যুক্ত হয়। সেই থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব পালন করেন; যদিও সরকারের দৃষ্টিতে এমডির নির্দিষ্ট বয়স পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। এ ব্যাপারে সংশোধনীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ সংশোধনী আনলেও সরকার নতুন এমডি নিয়োগ দেবে না। এক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ তিন সদস্যের কমিটিই নতুন এমডি নিয়োগ দেবে।
জানা গেছে, ওই সময় মালিকানা বিন্যাসের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মালিকানা কমতে থাকে। বর্তমান গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মোট মালিকানা নেমে দাঁড়িয়েছে আড়াই শতাংশে। অপর দিকে ৮৪ লাখ ঋণগ্রহীতার অর্থে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৯৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের বক্তব্য হচ্ছে সরকারের মালিকানার শেয়ার কমে যাওয়ার পরও নতুন মূলধন দিয়ে শেয়ার বৃদ্ধি করেনি সরকার।
এদিকে বৃহস্পতিবার গ্রামীণ ব্যাংকের তদন্ত কমিশন অর্থ মন্ত্রণালয়ে বেশ কিছু তথ্য নেয়ার জন্য আসে। রেয়াতি ট্যাক্সের টাকা কোন্ খাতে খরচ করা হয়েছে, মালিক হিসাবে সদস্যদের ডিভিডেন্ড দেয়া হতো কি না, এ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক কত টাকা আয় করেছে এসব বিষয়ে খোঁজখবর হচ্ছে। কমিশন মনে করছে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের বেতনভুক্ত এমডি ছিলেন। তাঁর নিজের কোন বিনিয়োগ নেই।
ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠান থেকে আরও ৩৭টি কোম্পানি সৃষ্টি করা হয়েছে। ওইসব কোম্পানির অর্থের উৎস কি তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া এই ব্যাংকের ব্যাপারে সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকেও টাকা এনে দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্যাক্স মওকুফ করেছে। ট্যাক্স মওকুফের টাকা কোন্ খাতে ব্যয় করা হয়েছে তাও দেখা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
২০১০ সালের হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পদ ও সম্পত্তির পরিমাণ হচ্ছে ১২ হাজার ৫শ’ ৩৯ কোটি ৬৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ হচ্ছে ৫৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.