ঈর্ষণীয় সফলতাই মুজিব হত্যার কারণ by সরদার সিরাজুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশের পর) সৌদি ও গণচীন স্বীকৃতি (যা চূড়ান্ত পর্বে ছিল বঙ্গবন্ধুর আমলেই) এসেছে যথাক্রমে ১৬ আগস্ট, ১৯৭৫ ও ৩০ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে। ১৯৭২ সালের মধ্যেই জাতিসংঘের সদস্যপদ (১৮ সেপ্টেম্বর ’৭৪)। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়Ñ এই মূল ভিত্তির পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তৎকালীন বিশ্বে মুজিব যে কতটা প্রভাবশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসে।


১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলজিয়ার্স জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন মধ্যমণি যা ইন্দিরা গান্ধীকেও বিচলিত করেছিল বলে শোনা যায়। কার্লমার্কসের বিশ্বখ্যাত উক্তির পুনরাবৃত্তি করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বিশ্ব আজ দু’ভাবে বিভক্ত। শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের দলে।” ফিদেল ক্যাস্ট্রো এই ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন “মুজিব শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের এই সংগ্রাম আমারও সংগ্রাম।” এই সময় তৎকালীন বিশ্বের সেরা ডিপ্লোম্যাট বাদশাহ ফয়সল একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন বাংলাদেশকে সৌদি স্বীকৃতি/ সাহায্য পেতে হলে দেশের নাম ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে সৌদি বিরোধিতার প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধু বাদশাহকে বলেছিলেন ‘ওয়াই ডিড য়্যু নট রেইজ ইউর ফিংগার এগেনস্ট দ্য কিলিং অব মাই পিপল।” বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, ‘আপনার দেশের নামও তো ইসলামিক রিপাবলিক অব সৌদি আরাবিয়া নয়।” আমার তো মনে হয় না বাংলাদেশের মিসকিনের মতো আপনাদের কোন সাহায্য চেয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানেরা কাবা ঘরে নামাজ আদায় করতে চায় যার ওপর তাদের হক রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যার ভূমিকা সর্বজনবিদিত এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশাকারী বলে কথিত তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত শেষে গণভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এ ম্যান অব ভাস্ট কনসেপসন, আই হ্যাভ রিয়েলি মেট এ ম্যান এ ম্যান হু ইজ দ্য ফাদার অব হিজ নেশন।” জাতিসংঘের সদর দফতরে মুজিবের আগমন বার্তা শুনে জাতিসংঘের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ সব সাফল্য একান্তই মুজিবের জন্য।
সীমাহীন আর্থিক সঙ্কট (ঋণ, অনুদান, সাহায্য এসেছিল মাত্র ২৯৮ কোটি ডলার, যা টাকার অঙ্কে ১৫০০ কোটির কম, বছর গড়ে মাত্র ৩৭৫ কোটি) দেশী বিদেশী ষড়ষন্ত্র মোকাবেলা বিশেষ করে জাসদ-সর্বহারার প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও মুজিব মাত্র সাড়ে তিন বছরে দেশকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে সক্ষম হন। পঁচাত্তরে দেশের আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসন, উৎপাদন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে শুরু করে। সাধারণ মানুষ আশান্বিত হয়। কিন্তু মুজিব হত্যা বাঙালীকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে দেয়নি। স্তব্ধ করে দেয়া হয় প্রগতির চাকা।

হত্যার কারণ

তৃতীয় বিশ্বের একজন রাষ্ট্রনায়ক ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে কেন ঘটল বিশ্বের নৃশংসতম হত্যাকা-? হত্যাকারীরা অজুহাত দাঁড় করায় রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা-একদলীয় শাসন-ভারতের কাছে দেশ বিক্রি ইত্যাদি। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা বা একদলীয় শাসনের অজুহাতে কোন রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করা হয়েছে ইতিহাসে তো এমন কোন নজির নেই। বিশ্বের পরাশক্তি যারা বিশ্বব্যাপী শোষণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতেই বেশি তৎপর তারা বরং সেসব রাষ্ট্রনায়ককে বাঁচিয়ে রেখে সাহায্য সহযোগিতা করে। তার প্রমাণ ইরানের শাহ, ফিলিপিন্সের মার্কোসসহ অনেক এবং এদেশে এরশাদ। বস্তুত নিজের জনগণের মঙ্গল কামনায় অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্রনায়করা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তাদের বাঁচতে দেয় না। মুজিবের ভাগ্যেও তাই ঘটেছে। প্রবল মার্কিন বিরোধিতার মধ্যে বাংলাদেশের জন্ম। প্রতিষ্ঠাতা মুজিব যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপোস করতেন তাহলে জীবন দিতে হতো না। ১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের এক সপ্তাহ পরে মুজিব জাতিসংঘের যে ভাষণ (বাংলায়) দেন তাতে তৃতীয় বিশ্বকে ‘শর্তযুক্ত ঋণ’ প্রত্যাখানের আহ্বান জানিয়ে একই সফরে (৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪) নিজের দেশের অবস্থান মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফোর্ডকে জানানোর পরে মার্কিনীরা কি তাকে ছেড়ে দেবে? যে নীলনকশা প্রণীত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তা বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত ওরা ভেবেছিল মুজিব ভারত বিদ্বেষী। দ্বিতীয়ত মুজিবকে দিয়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষিত হবে। মুজিবকে ভারত যে গ্রাস করতে পারেনি সেজন্য তাকে সরিয়ে দেয়ার নীল নকশা বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয় সাড়ে তিন বছর। মার্কিন স্বার্থ রক্ষা মুজিবকে দিয়ে হলো না বরং মুজিব সমাজতন্ত্রের দিকে, সমর্থন দেয় মার্কিন প্রতিপক্ষ ভিয়েতনামের মুক্তিকামী মানুষকে, পাট চুক্তি করে কিউবার সঙ্গে তখন আর তাকে বাঁচতে দেয়া যায় না। যেমনি দেয়নি ১৯৭৩ সালে চিলির আন্দোলনকে। শত্রুরা স্বীকার করুক আর না করুক এটাই সত্য যে, ’৪৭ থেকে বাঙালী জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ মুজিব সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী দিয়েছিলেন ৯৫ ভাগ জনগোষ্ঠীর জন্য যা স্বেচ্ছাপ্রণোদিতÑ জনক হিসেবে সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে এবং তা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নয় (ক্ষমতা এমনিই ছিল) এবং ইহাই মুজিব হত্যার প্রধান কারণ।

জাসদ প্রসঙ্গে

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন কি তার শত্রুরাও স্বীকার করবে যে মুজিব ভারত, মার্কিন, সোভিয়েতপন্থী ছিলেন না। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালী। বাঙালীরা এই ভূখ-ের মালিক, বাঙালী জনগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্র ক্ষমতা, অর্থনৈতিক কর্মকা- এবং তা বাঙালীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে। এমনি জাতীয়তাবাদী নেতাকে বিশ্ব মোড়ল এমনকি প্রতিবেশী ভারতের সহ্য হয় না। তাই কাট টু সাইজ রাখার লক্ষ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতে মুজিবকে দুর্বল করার জন্য প্রথমেই যে মিলিট্যান্ট টগবগে তরুণ, যারা মুজিবের অতিভক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী নাম ধারণ করেছিল তাদের বড় একটি অংশ এবং সেনাবাহিনীর কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে মুজিবকে প্রবল বিরোধিতার মুখে দাঁড় করাতে শত্রুরা সক্ষম হয়েছিল। ’৭২-৭৫ সালে জাসদের এবং সন্তোষে মাওলানা ভাসানীর আশ্রয়ে ছিল চৈনিক-রাজাকার-আলবদর বাহিনীসহ মুসলিম লীগের ধনীক শ্রেণী। আওয়ামী লীগের অন্তুত ৪ জন গণপরিষদ সদস্যসহ প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, এমনকি ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করেছে। এদের মুখপাত্র গণকণ্ঠ রাষ্ট্র, সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক মিথ্যা খবর ছাপাত নিয়মিতভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে বিশেষ করে নভেম্বরের ৩-৭ তারিখে পর্যন্ত এদের একজন নেতা কর্নেল তাহের ক্যান্টনমেন্টে হাজার হাজার লিফলেট বিতরণ করে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ক্ষেপিয়ে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেছে। অফিসারদের হত্যা ও চেন অব কমান্ড নষ্ট করেছে। এসব করেছিল ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার কল্পনা বিলাসে। যদিও যে কর্নেল তাহের তার বন্ধু জেনারেল জিয়াকে রক্ষা ও ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন তার হাতেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। জাসদের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা কি ছিল তা ইতিহাসের গবেষণার বিষয়। তবে এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে মুজিব তথা বাঙালী জাতির আশা আকাক্সক্ষাকে নস্যাত করার জন্যই জাসদ, একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জাসদ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। সভাপতি মেজর জলিল হাফেজী হুজুরের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান শেষে পাকিস্তানে দেহত্যাগ করেন। সম্পাদক আ.স.ম. রব এরশাদের গৃহপালিত অবশ্য ’৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের মন্ত্রিসভার জাসদ নেতা হিসেবে যোগ দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে প্রায়শ্চিত্ত করেননি, মজা খেয়ে এখন প্রতিক্রিয়াশীলদের দলে। আরও কয়েকজন অবশ্য সরাসরি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন যাদের অনেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন। আর শাহজাহান সিরাজ যোগ দিয়েছেন ম্যাডাম জিয়ার বিএনপিতে, মন্ত্রী হয়ে লুটেছেন, এখন বর্জ্য। খলিফার এই পরিণতি। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল কিনা সে বিষয়ে কোন মন্তব্য রাখার প্রয়োজন নেই তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জাসদের অবলুপ্তি বলে দেয় মুজিবকে ধ্বংস করার জন্য যেন জাসদের জন্ম হয়েছিল। ১৯৭২ সালে জাসদ নেতারা যদি মাটি কামড়ে মূল ধারায় অবস্থান করত তাহলে তারাই যথাসময়ে মূল ধারা নেতৃত্বে আসতে সক্ষম হতো।

মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন আহম্মদের পদত্যাগ

জাসদ সৃষ্টির পরেও আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালই ছিল। তবে ডানপন্থীরা সুবিধা পায়। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পরীক্ষিত বন্ধুদের দূরে সরিয়ে রাখার কাজেও শত্রুরা সফল হয়। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধকে মাত্র ৯ মাসে সফলতা দানে সক্ষম হয়েছিলেন। দুর্দিনের সেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হয়। মন্ত্রিসভা থেকে ১৬ অক্টোবর ৭৪ তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করার একবছর না যেতেই বঙ্গবন্ধু শাহাদৎবরণ করেন।
বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে দিয়ে যে কঠিন কাজটি করাতে পরেছিলেন, তাজউদ্দীনবিহীন সেই সরকার আর টিকল না কেন তারও মূল্যায়ন হওয়া উচিত। তাজউদ্দীন আহমদ বিদ্রোহ করেননি, প্রতিশোধ নেননি বরং বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেও নেতার প্রতি আনুগত্যের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রাখলেন আত্মাহুতির পথে (জেল হত্যা ৩ নভেম্বর, ’৭৫)। কেন যেন মনে হয় তাজউদ্দীন আহমদ যদি যে সময় বাকশালের সম্পাদক (তাকে বাকশালের ১১৫ সদস্য কমিটিতেও রাখা হয়নি) থাকতেন তাহলেও তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হতো। (চলবে)
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.