সরকারী খরচে হুমায়ূনের চিকিৎসায় প্রবাসী বাঙালীরা বিস্মিত হয়নি by মাহফুজুর রহমান

নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর নিউইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিকগুলো একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে চমক সৃষ্টি করতে গিয়ে তাঁর (হুমায়ূনের) সরকারী খরচে (মেডিকেইড-এ) চিকিৎসা গ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরেছে। কিন্তু এ তথ্যে প্রবাসী বাঙালীরা তেমন বিস্মিত হননি।
কারণ হুমায়ূনের আগে বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তি নিউইয়র্কে এসে এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থার এই সুযোগ নিয়েছেন। এঁদের কেউ কেউ দেশের ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতা আবার কেউবা অভিনেতা বা অভিনেত্রী অথবা বড় মাপের সঙ্গীতশিল্পী। তালিকায় আরও আছেন দেশের বড় বড় শিল্পপতি থেকে শুরু করে বিচারক, সাহিত্যিক-সাংবাদিকও।
নেতাদের মধ্যে চিকিৎসা নেয়া কেউ কেউ ইহলোকও ত্যাগ করেছেন। যেমন বিএনপির সাবেক মহাসচিব মান্নান ভূইয়া। আর জীবিতদের অনেকেই প্রতিবছর নিউইয়র্কে এসে ফ্রি চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার গ্রীনকার্ডধারী। এ ধরনের চিকিৎসা নেয়ার পাল্লায় এগিয়ে আছেন বিরোধী দল বিএনপির নেতারা। এ দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা পুলিশের নির্যাতনে আহত হওয়ার পর গত এক বছরে ক’বার নিউইয়র্কে এসে চিকিৎসা করিয়ে দেশে ফিরে গেছেন। আওয়ামী লীগের এক নেতা যিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের এবং এক এগারোর পুরো সময়টাই নিউইয়র্কে অবস্থান করে শুধু সাধারণ চিকিৎসা নয়, দুর্ঘটনাজনিত মামলায় বিশেষ চিকিৎসা করিয়েছিলেন ইন্স্যুরেন্সের বড় অঙ্কের অর্থ পাওয়ার জন্য। এক সময়ের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতির প্রবাদপুরুষ দুয়েক কমিউনিস্ট নেতাও নিউইয়র্কে এসে এ রকম ফ্রি চিকিৎসা করেছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাও গত দু’বছরে তাঁর নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ক‘বার নিউইয়র্কে এসেছেন। শেষবার বেশ ক‘মাস থেকে স্ত্রীর দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ নেতা ও বিরোধী নেত্রীর উপদেষ্টা নেতা দু’জনই আবার আমেরিকার গ্রীনকার্ডধারী বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির এক নেতাও এই তালিকায় রয়েছেন। তিনিও গ্রীনকার্ডধারী।
রাজনীতিবিদের এরকম ফ্রি চিকিৎসা পেতে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকেন তাদের মতাদর্শের চিকিৎসকরা। এসব চিকিৎসক নিউইয়র্কের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক। তাঁরা বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর বের করে তাদের প্রিয় নেতাদের লাখ লাখ ডলারের চিকিৎসা বিনামূল্যে করে দিয়ে নিজেদের ধন্য মনে করেন।
সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আব্দুল জব্বার ও সুবীর নন্দী এখানকার এই চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গিয়ে আবার তাঁদের সৃষ্টিশীলতা বজায় রেখেছেন।
অভিনেতাদের চেয়ে অভিনেত্রীরা এখানকার ফ্রি চিকিৎসার সুযোগটি বেশি ব্যবহার করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অনেকেই এখানে তাঁদের সন্তান জন্ম দেয়ার বিষয়টি সম্পন্ন করে একদিকে বিনা খরচে বা অল্প খরচে তা সম্পন্ন করেন এবং একই সঙ্গে তাঁদের নবজাতক সন্তানকে আমেরিকার পাসপোর্টের অধিকারী বানাচ্ছেন। এটা সবাই জানেন যে, বাংলাদেশের টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় অভিনেতা দম্পতি নিউইয়র্কে এসে দীর্ঘদিন অবস্থান করে এখানেই তাঁদের সন্তান ভূমিষ্ঠ করিয়েছেন। অভিনেত্রীদের কেউ কেউ আবার তাঁদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্লাস্টিক সার্জারিও করিয়ে নিচ্ছেন কম খরচে বা নামমাত্র ব্যয়ে।
এসব সুবিধা নিতে হুমায়ূন আহমেদের বেলায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাৎ ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে মেডিকেইড সিস্টেমের কোন ইন্স্যুরেন্স নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অথবা না হয়েও বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সাধারন চেক আপ থেকে শুরু করে হৃদরোগের মতো বিশাল ব্যয়ের চিকিৎসা সুযোগ গ্রহণ করছেন।
বাংলাদেশের অনেক শিল্পপতি যাঁদের বেশিরভাগই আমেরিকার গ্রীনকার্ডধারী তাঁরা এখানে এসে নিম্ন আয়ের কাগজপত্র দেখিয়ে উন্নত ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা করিয়ে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিল্পী কলা-কুশলী যাঁরা গ্রীনকার্ডধারী তারা এই সুযোগ অব্যাহতভাবে ব্যবহারের জন্য প্রতিবছর সামান্য আয় দেখিয়ে ট্যাক্স ফাইলও করে থাকেন বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের বাড়তি সুবিধা হয়, কারণ তখন আর তাঁদের আর মিথ্যা কাগজ পত্রের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। আর তাই দেখা যায় বছরের প্রথম দিকে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ট্যাক্স ফাইলিংয়ের মৌসুমে এঁদের অনেকেই বেড়ানোর নামে আমেরিকায় এসে ট্যাক্স ফাইলিংয়ের কাজটা সেরে নেন এবং একই সঙ্গে চিকিৎসাও করিয়ে যান।

No comments

Powered by Blogger.