ঠেলা লাগব নি সাব, ঠেলা- ঐতিহাসিক ক্বিনব্রিজ

ঠেলা লাগব নি সাব, ঠেলা লাগব বাক্যটি খুবই পরিচিত। সিলেটবাসী তথা বাইরে থেকে আগত ক্বিনব্রিজ দিয়ে যাতায়াতকারী সকলেই এই বাক্যের মর্ম বোঝেন। কাকডাকা ভোর থেকে রাত অবধি রিক্সার পেছনে ঠেলা ঠেলে তাদের সময় কাটে। ঠেলাওয়ালারা লোকজনের কাছে ‘ঠেলা’ নামে পরিচিত।


হয়ত ক্বিনব্রিজের গোড়ায় কখনও ৪/৫ জন ঠেলাওয়ালা দাঁড়িয়ে গল্প-গুজবে বেখেয়াল হয়ে গেছে, এমনি সময়ে যাত্রীসহ রিক্সা ক্বিনব্রিজ পেরিয়ে যেতে রিক্সা চালক ‘এই ঠেলা’ বলে ঠেলাওয়ালাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেই ঠেলাওয়ালা ছুটে আসতে বিলম্ব করবে না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, এই ঠেলার ডিউটি চলছে। অনেকেই দীর্ঘদিন যাবত ঠেলাওয়ালা হিসেবে এই পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। আবার অনেকে আপদকালীন সময় অতিবাহিত করতে ঠেলা ঠেলে দু’ টাকা রোজগার করার পথ বেছে নেন। হঠাৎ করে নগরীতে নতুন এসে বেকায়দায় পড়ে গেছে অথবা মজুর শ্রেণীর লোক কাজ পায়নি তখন তারা ঠেলার কাজে লেগে যায়। এতে অন্তত তাৎক্ষণিক কাজের সমাধান পেয়ে যাচ্ছে। এখানে বলিষ্ঠদেহের অধিকারী যুবকদের কদর বেশি। মধ্যবয়সী, রুগ্ন চেহারার ঠেলাওয়ালাদের কাজে লাগাতে নাখোশ রিক্সা চালকরা। কারণ তারা ভালভাবে ঠেলতে পারে না। লোকমান, বাড়ি কিশোরগঞ্জ, বয়স ২৫/২৬ বছর, মাঝারি স্বাস্থ্য, ৩ দিন যাবত ঠেলার কাজে নিয়োজিত। নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় রাত যাপন করে। বাড়ি থেকে রাগ করে এসেছে। প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন শ’ টাকা রোজগার হয়। বেশ ভালই চলছে বলল লোকমান, বেকার থাকার চেয়ে রিক্সা ঠেলে ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা আয় কম কি সে? অন্য কাজের ধান্ধায় আছে লোকমান। ঠেলা ঠেলতে খুবই কষ্ট। একবার ঠেলা ঠেলে ৫ টাকা পাওয়া যায়। পূর্বে ঠেলার মজুরি ২ টাকা ছিল। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কথা ভেবে ঠেলাওয়ালারা সবাই মিলে ২ টাকা থেকে ঠেলা ভাড়া ৫ টাকায় বৃদ্ধি করেছে। গত ২ বছর যাবত ৫ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে। ২ টাকা থেকে ৫ টাকায় বৃদ্ধি করার পর প্রথমদিকে রিক্সা চালকরা বাড়তি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানাত। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন ঝগড়াঝাটি ছিল। এরপর বাধ্য হয়ে রিক্সা চালকরা ৫ টাকা ঠেলা ভাড়া দিতে শুরু করে। লোকমান ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। দেশে কাজকর্ম নেই, বেকার জীবন। বাবার সঙ্গে রাগ করে সিলেট এসে চাকরির ধান্ধা করছে। গ্রামের সম্পর্কিত মামার বাসায় কোনরূপে রাতেরবেলা মাথা গোঁজার ঠাঁই। মামাও পেশায় রিক্সাচালক, কলোনিতে বসবাস। বাড়ি থেকে প্রথম আসার দিন লোকমান গাড়ি থেকে ক্বিনব্রিজ পেরিয়ে নগরীতে ঢুকতেই চোখে পড়ে ঠেলার দৃশ্য। তাই পরদিন আশ্রয়দাতা মামাকে না বলেই ঠেলার কাজে এসে যোগদান করে। তবে এখানেও বিপত্তি আছে। হুট করে এসেই ঠেলা ঠেলতে সুযোগ পাবে না। পুরনোদের সঙ্গে বোঝাপাড়া করে কাজে লাগতে হবে। লোকমান নিজের অসহায়ত্তের কথা তুলে ধরে সংশ্লিষ্টদের সন্তুষ্ট করে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায়। ক্বিনব্রিজের দু’পাশ থেকেই ঠেলাওয়ালারা রিক্সা ঠেলে থাকে। বর্তমানে দুই শতাধিক বিভিন্ন বয়সের লোক ঠেলা ঠেলে জীবিকা নির্বাহ করছে। হেরোইনসেবী মস্তানদের খপ্পর থেকে তারাও রেহাই পাচ্ছে না। প্রায়ই অপরাধীচক্র তাদের ওপর চড়াও হয়ে চাঁদা আদায় করে থাকে। নিরাপত্তার কথা ভেবে কেউ প্রতিবাদ করে না। ১০/২০ টাকা দিয়ে রেহাই পেতে চায়।
সিলেট শহরকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে সুরমা নদী। রাখীবন্ধনে বেঁধেছে ক্বিনব্রিজ। এক সময় ভোরের সূর্য যখন ক্বিনব্রিজে লোহার শরীর স্পর্শ করত রিক্সা টুং টাং শব্দ বেজে উঠত তখন ব্রিজে লোহার বিশাল পিঞ্জিরা থেকে ঝাঁকে ঝাঁজে কবুতর আকাশে ডানা মেলত, সকালের চোখ জুড়ানো এই দৃশ্য সবাইকে আকৃষ্ট করত। এক শ্রেণীর লোক রাতের অন্ধকারে ব্রিজের পিঞ্জিরা থেকে কবুতর ধরে এনে বিক্রি করতে থাকে। দীর্ঘসময়ে ব্রিজের পিঞ্জিরা এখনও কবুতরশূন্য হয়ে পড়েছে। ১৯৩৬ সালে সিলেট শহর দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর উপর ক্বিনব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। সে সময় ব্রিটিশ ভারতের আসাম রাজ্যের গবর্নর ছিলেন মাইকেল কিন। তাঁর আমলে তৈরি বলেই ব্রিজটির নাম ক্বিনব্রিজ। ১৯৩৬ সালের আগে শহরের দুই অংশে যোগাযোগ রক্ষা করত খেয়ানৌকা। তখন আসাম সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদ এবং এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য রায় বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত উদ্যোগ নেন একটি ব্রিজৈ তৈরির। ১৯৩৩ সালে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ করতে সময় লাগে ৩ বছর এবং ব্যয় হয় ৫৬ লাখ টাকা। ব্রিজটি ১১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যে এবং ১৮ ফুট প্রস্থে। ১৯৩৬ থেকে এই ব্রিজের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অনেক ইতিহাস। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের একটি জনসভায় ছাত্ররা এই ব্রিজে দাঁড়িয়ে জুতা ছুড়ে মেরেছিল। অনেক আন্দোলন এবং অনেক আনন্দের সাক্ষী এই ব্রিজ। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণআন্দোলন, ৭১’র স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে এই ক্বিনব্রিজ বেয়ে দক্ষিণ সুরমা থেকে মিছিল যেত মূল শহরে। সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রারি মাঠে ও গোবিন্দ পার্কে জনসভা হতো। সন্ধ্যায় হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে বের হয়ে যেত এই শহর ব্রিজ পার হয়ে। এখনও দক্ষিণ সুরমা থেকে ক্বিনব্রিজ দিয়ে শহরে মিছিল আসে। ব্রিজের লোহার কাঠামোতে সেøাগান প্রতিধ্বনিত হয়।
ক্বিনব্রিজ সিলেট শহরে ব্যবসা বাণিজ্য ও যোগাযোগে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৩৬ সালের পর এই ব্রিজটি সিলেট শহরের চেহারা পাল্টে দিয়েছিল। ক্বিনব্রিজের লোহার কাঠামো এবং শহর জুড়ে থাকা শ্যামল গাছের সঙ্গে বাংলো টাইপের স্থাপত্যের বাড়ি মিলে শহরটি হয়ে উঠেছিল অভিজাত। এখনও ক্বিনব্রিজ সিলেট শহরের গেটওয়ে। ক্বিনব্রিজের উপস্থিতি ছাড়া সিলেট শহর যেন অসম্পূর্ণ। যখনই যে কেউ এই শহরে আসেন তাঁরা ফিরে যান ক্বিনব্রিজের স্মৃতি নিয়ে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী আত্মরক্ষার জন্য ক্বিনব্রিজের উত্তর অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর জোড়াতালি দিয়ে ব্রিজটিকে আবার চলাচলের উপযোগী করা হয়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই ব্রিজে পালাক্রমে উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং দক্ষিণ থেকে উত্তরে যান চলাচল করত। এ সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতায় ব্রিজটির ভাঙ্গা অংশগুলো নির্মিত হয়। ব্রিজটি ১৯৩৬ সালের কাঠামো ফিরে পায়।
ব্রিজটি নির্মাণের সময় ঘোষিত আয়ুষ্কাল ১৯৮৬ সালে পার হয়ে গেছে। এখন আর ক্বিনব্রিজ ভারি যানের বোঝা বইতে পারে না। সারাদিন শুধু রিক্সা পারাপার চলে। সেই সঙ্গে হেঁটে পার হয় হাজার হাজার মানুষ। সিলেটবাসীর ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ক্বিনব্রিজ। ক্বিনব্রিজের পাশেই স্থাপিত হয়েছে আলী আমজদের ঘড়ি। আর ব্রিজের উল্টর পাশে সুরমার তীরে রয়েছে চাঁদনীঘাটের সিঁড়ি। ক্বিনব্রিজ ও আলী আমজদের ঘড়ির সঙ্গে ব্রিটেনের বিগবেন ঘড়ির ও টাওয়ার ব্রিজের মিল খুঁজতে চেষ্টা করেন অনেক সিলেটবাসী।
সালাম মশরুর, সিলেট অফিস

No comments

Powered by Blogger.