এনবিআরে দুর্নীতির খোঁজে দুদক by মোশতাক আহমদ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে জোরেশোরে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে দুদকের কর্মকর্তারা এনবিআরের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই- বাছাইয়ের জন্য আয়কর-সংক্রান্ত দুই শতাধিক ফাইল জব্দ করেছেন।


এ ছাড়া গত এক বছরে আয়কর আইনজীবীসহ এনবিআরের ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
এনবিআর কর্মকর্তাদের দুর্নীতির মহোৎসবের অভিযোগ পেয়ে গত মার্চ মাসে দুদকের একটি দল কাজ শুরু করে এনবিআরে। তিন সদস্যের তদন্ত দলটির প্রধান হচ্ছেন দুদকের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ। গত তিন মাসে তাঁরা এনবিআরের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আবদুল্লাহ আল জাহিদ কালের কণ্ঠকে এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করছেন।
দুর্নীতি রোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সাড়ম্বরে চালু করা হয়েছিল 'সততা বিভাগ'। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সততা বিভাগ চালু করে এনবিআর। কিন্তু এরপরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি থেমে নেই। বরং বেড়েই চলেছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, এনবিআরে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণীর অনেক কর্মচারী বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন, যার কোনো বৈধ উৎস নেই। তৃতীয় শ্রেণীর একাধিক কর্মচারীর ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি ও একাধিক ফ্ল্যাটের খোঁজ পেয়েছে দুদক। এনবিআরের এসব কর্মকর্তার দুর্নীতির অনুসন্ধানে এখন কাজ করছে দুদক।
কর খাতে লাগামহীন দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'দুর্নীতি হচ্ছে না না- তা বলব না। তবে দুর্নীতি ঠেকাতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। দুদকের একটি টিমও কাজ করছে বলে তিনি জানান। এনবিআরে দুর্নীতি রোধে সততা বিভাগ চালু করেও কেন দুর্নীতি ঠেকানো যাচ্ছে না, কেন এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সততা বিভাগের কার্যক্রম বেগবান করার বিষয়ে এরই মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এতে জনবল বাড়ানো হবে।'
টিআইএন নম্বরধারী ৩২ লাখ, আয়কর দেয় ৯ লাখ : দুদক ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, দেশে টিআইএন নম্বরধারীর সংখ্যা ৩২ লাখ হলেও বছরে আয় কর রিটার্ন জমা দেন মাত্র ৯ লাখ লোক। অবৈধ পন্থায় দুর্নীতিবাজ আয়কর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অনেকেই আয়কর দেন না। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, 'রাজস্ব জমা দিতে এলে অমনক ক্ষেত্রে এনবিআরের কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম ব্যাহত হয়।'
কর ফাঁকি দিচ্ছেন রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারাই : দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজস্ব বোর্ডের অনেক কর্মকর্তা অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের তথ্য গোপনের মাধ্যমে নিজেরাও কর ফাঁকি দিয়ে আসছেন। ফলে সরকার প্রতিবছর মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। এ বিষয়ে অসংখ্য অভিযোগ জমা হলে দুদক তা পর্যায়ক্রমে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর অংশ হিসেবে ৬০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং আরও শতাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক।
আয়কর দাঁতাদের সঙ্গে আঁতাত : এ ছাড়া রাজস্ব বিভাগের অধীন কর বিভাগ, কাস্টমস, ভ্যাট ও এক্সাইজের অসৎ কর্মকর্তারা আয়কর দাতাদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রতিবছর সরকারের বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিতে সহায়তা করে আসছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর বিনিময়ে আয়কর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বনে গেছেন কোটিপতি।
অর্ধশতাধিক মামলা : গত এক মামলায় যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন এনবিআরের সাবেক সদস্য এম আজিজুর রহমান, সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, সাবেক উপকর কমিশনার মো. আ. শুকুর, সাবেক কাস্টমস সুপার শেখ আকরাম হোসেন, সাবেক এপ্রেইজার সৈয়দ সোবহান, সাবেক ইন্সপেক্টর মো. আ. মমিন, আজিজুল হক মোল্লা, খন্দকার মাসুদুর রহমান, মো. মোশারফ হোসেন ও মো. শওকত আলী। সহকারী কর কমিশনার (সাময়িক বরখাস্ত) আনিছুর রহমান তালুকদার, কাস্টমস ঢাকা উত্তরা সার্কেলের সুপারিনটেনডেন্ট শাহাদাত হোসেন, কাস্টমস ইন্সপেক্টর মো. আতাউর রহমান আকন্দ, মো. মামুনুল হক চৌধুরী, মো. ইয়াদুর রহমান মোল্লা, ছাদেকুর রহমান, মজিবুর রহমান সরকার (সাময়িক বরখাস্ত), প্রিন্সিপাল এপ্ররাইজার (সাময়িক বরখাস্ত) মো. মাহফিজুর রহমান, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল কাশেম প্রমুখ।
এ ছাড়া কর ফাঁকির অনেক ঘটনায় এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আয়কর আইনজীবী জড়িত থাকার কারণে দুদকের এ ধরনের মামলায় আয়কর আইনজীবীদেরও আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মো. মোস্তফা খান, মো. মুজিবুর রহমান, এম হারুন অর রশিদ, এম এস আলম, এস এম নুরুজ্জামান, শেখ আলিউর ইসলাম ও গোলাম রহমান।

No comments

Powered by Blogger.