গুলশানের ভেতর-বাহির-৩-দখলে দূষণে লেকের বারোটা by আপেল মাহমুদ

ছোট হয়ে আসছে গুলশান লেক। বেশ কিছু বহুতল ভবনের একাংশ লেকের ভেতরে ঢুকে গেছে। আর দূষণের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, পচা পানির কটু গন্ধে লেকের ত্রিসীমানায় টেকা দায়। গুলশান লেকের বিভিন্ন অংশ ঘুরে আরো দেখা গেছে, লেকের প্রায় ৪০ শতাংশ জায়গা কোনো না কোনোভাবে বেদখল হয়ে আছে।


প্রথমে ধীরে ধীরে মাটি ও ময়লা-আবর্জনা ফেলে লেকের পাড় ভরাট করা শুরু হয়। পরে সুযোগ বুঝে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয়। তবে গুলশান লেক সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে কড়াইল বস্তি, নিকেতন আবাসিক এলাকা, শাহজাদপুরের মরিয়ম টাওয়ার এবং শুটিং ক্লাব পর্যন্ত। গুলশান এক নম্বর রোড দিয়ে নিকেতন আবাসিক এলাকার প্রবেশ পথের পাশে লেক এলাকায় একটি সতর্কীকরণ সাইনবোর্ডে লেখা আছে, লেক দখল কিংবা দূষণ দণ্ডনীয় অপরাধ। ঠিক সাইনবোর্ডের নিচেই লেকের পারে ইট-বালুর দোকান বসানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে লেকের তীর থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে প্রায় ১৫ একর জমি উদ্ধার করা হয়।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এবং বিচারপতি মো. মমতাজউদ্দিন আহমেদের বেঞ্চ ২০১০ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গুলশান-বনানী ও গুলশান-বারিধারা লেকের দখলদার চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সীমানা নির্ধারণ করে আয়তন নির্ধারণের নির্দেশ দেন। একই বছরের ১৪ জুলাই এক রায়ে গুলশান লেককে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেন আদালত। এরপর সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ২৫ জানুয়ারি বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে লেক থেকে সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক লেক ও এর আশপাশে অভিযান চালিয়ে ৩২২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে।
গুলশান সোসাইটির নির্বাহী সম্পাদক মো. সফিকুর রহমান বলেন, লেক অবৈধভাবে দখল হলে তা সবার দৃষ্টিতে পড়ে। কিন্তু লেকের পানি কেউ দূষিত করলে তা সহজে চোখে পড়ে না। যার কারণে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, লেকের পাড়ে অবস্থিত বেশির ভাগ বাড়ির স্যুয়ারেজ লাইন লেকের পানির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য লেকের পানিতে মিশছে। এতে পুরো এলাকা দুর্গন্ধময় হয়ে পড়েছে। লেকের পাশে গেলে নাকে রুমাল দিতে হয়। বিশেষ করে বাড্ডা লিংক রোড থেকে গুলশান এক নম্বরে আসার পথে লেকের পাশে অবৈধ একটি কাঁচাবাজার থেকে প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রকাশ্যে। তা ছাড়া নিকেতন এলাকায় হাতিরঝিল প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ রাবিশ লেকের মধ্যে ফেলতে দেখা গেছে। কড়াইল বস্তিতে বসবাসরত হাজার হাজার মানুষের পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা হলো গুলশান-বনানীর লেক।
গুলশানের বাসিন্দা ও এনজিওকর্মী সাবিহা সুলতানা বলেন, দূষণকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি জানান, লেকে শুধু বাসাবাড়ির বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে না, পার্শ্ববর্তী বাড্ডা, বনানী ও তেজগাঁওয়ের দুই শতাধিক শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্যও সরাসরি লেকের পানিতে ফেলা হচ্ছে। এমনকি সেপটিক ট্যাংক নির্মাণের খরচ বাঁচাতে অনেক বাড়ির পয়োনালা লেকের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনও ময়লা-আবর্জনা নিষ্কাশনে ড্রেনের মুখগুলো লেকের সঙ্গে যুক্ত করেছে বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, লেকের পানি অতিমাত্রায় দূষিত হয়ে যাওয়ায় আশপাশে সব সময় উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। এরই মাঝে নির্বিচারে বর্জ্য ফেলা, গোসল করা, কাপড় কাচা চলছে। অনেক বাড়ির পয়োনিষ্কাশন হয় লেকের পানিতেই। এসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও তা অনেকেই মানছে না।
এ ব্যাপারে রাজউক চেয়ারম্যান মো. নুরুল হুদা বলেন, লেক দূষণ দণ্ডনীয় অপরাধ। দূষণ রোধের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ আদালত ইতিমধ্যে লেকের অবৈধ দখল উচ্ছেদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
রাজউকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, বর্তমানে গুলশান লেকে অবৈধ দখলদার প্রায় নেই বললেই চলে। দূষণ রোধের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। লেকের মধ্যে সংযোগ দেওয়া প্রতিটি স্যুয়ারেজ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এ জন্য আলাদা লাইন টানা হচ্ছে। তা ছাড়া গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে হাতিরঝিল প্রকল্প পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন এবং গুলশান লেকের দুই পারে ঢাকা ওয়াসা স্টর্ম স্যুয়ারেজ এবং চার হাজার ৯৫৪ কোটি টাকার পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারলে লেকের দূষণ সহনীয় পর্যায়ে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.